ইইউ-র সন্ত্রাসবাদী তালিকা কিভাবে তৈরি হয়?
২৪ জানুয়ারি ২০২৩অন্তত চারজন সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর ইরানের অভিজাত সেনা ইউনিট ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস- আইআরজিসিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে তালিকাভুক্ত করার কথা ভাবছে জার্মানি এবং ফ্রান্স৷ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের সঙ্গে মিলে এই দুই দেশ যৌথ নিরাপত্তা নীতির অধীনে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে৷
থিংক ট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর কাউন্টার টেরোরিজমের তানিয়া মেহরা জানিয়েছেন, ইইউ জোটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কাউন্সিলের পরবর্তী বৈঠক থেকেই এই সিদ্ধান্ত আসতে পারে৷ কিন্তু ঠিক কিভাবে সন্ত্রাসবাদের তালিকায় কোনো সংগঠন বা ব্যক্তির নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়, এবং এর পরিণাম কী হয়৷
তালিকার বিস্তারিত...
২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রথম এমন তালিকা তৈরি করে৷ সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিহ্নিত করা হয় এই তালিকায়৷ হামলার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত এক প্রস্তাবকে সমর্থন করে এই তালিকা প্রস্তুত করা হয়৷ এর লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসী এবং তাদের অর্থদাতাদের চিহ্নিত করা এবং তাদের অর্থ সরবরাহ ও চলাচল বন্ধ করা৷
প্রতি ছয় মাসে একবার ইইউ এই তালিকা পুনর্বিবেচনা করে৷ এই মুহূর্তে তালিকায় ১৩ জন ব্যক্তি এবং ২১টি গোষ্ঠীর নাম রয়েছে৷ ইইউ অঞ্চলের ভেতরে এবং বাইরে বোমা হামলা থেকে শুরু করে গুপ্তহত্যা পর্যন্ত নানা অপরাধ সংগঠনের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে৷
এই তালিকায় অন্তর্ভুক্তদের সকল সম্পদ জব্দ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ তালিকায় রেভোলিউশনারি গার্ডের নাম অন্তর্ভুক্ত হলে তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো সদস্য রাষ্ট্রে থাকা সম্পদ বা সম্পত্তি ব্যবহার করতে পারবে না৷ বাহিনীর সদস্যদের চলাচলেও আসবে বিধিনিষেধ৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিচারের মুখোমুখিও হতে পারেন৷
কেবল তাই নয়, তালিকায় থাকা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে ইইউর কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন আর্থিক বা অন্য কোনো সহায়তা করলে তাদেরকেও আনা হতে পারে নিষেধাজ্ঞার আওতায়৷
যেভাবে তৈরি হয় তালিকা
সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটানো বা ঘটানোর পরিকল্পনায় জড়িত বা সন্দেহভাজন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে৷ এমনকি যেসব ঘটনার তদন্ত করা হয়নি, সেসব ক্ষেত্রেও কেউ কেউ তালিকায় তাদের নাম দেখতে পারেন৷
ইইউ সদস্য রাষ্ট্র বা তৃতীয় কোনো রাষ্ট্রও তথ্য-প্রমাণসহ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নাম প্রস্তাব করতে পারে৷ এরপর ‘ওয়ার্কিং পার্টি অন রেসট্রিকটিভ মেজারস টু কমব্যাট টেরোরিজম' বা সংক্ষেপে কমেট নামের একটি বিশেষ গ্রুপ এই প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে৷
কমেটে ঠিক কারা রয়েছেন, সেটি স্পষ্ট নয়৷ তবে যদি কমেট সিদ্ধান্ত নেয় যে কাউকে তালিকাভুক্ত করা উচিত, তারা সেই প্রস্তাব ইউরোপীয় কাউন্সিলের কাছে জমা দেয়৷ ইইউ সব সদস্য রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান আছেন ইউরোপীয় কাউন্সিলে৷ এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ইউরোপীয় কাউন্সিলের দুই প্রধানও কাউন্সিলের সদস্য৷
এই প্রক্রিয়ার পাশাপাশি জাতিসংঘ যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার দায়ে চিহ্নিত করে, তার নামও ইইউ-র তালিকায় আসার সম্ভাবনা অনেক বেশি৷
তালিকায় এখন যাদের নাম রয়েছে
আল কায়েদা এবং এর অঙ্গসংগঠন, তথাকথিত ইসলামিক স্টেট এবং এর অঙ্গসংগঠনগুলো এই তালিকায় রয়েছে৷ ২০১৬ সালের একটি বিশেষ সিদ্ধান্তে আইএস বা এর সঙ্গে জড়িত কারো কাছে অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং অন্য কোনো সামরিক যন্ত্রপাতি বিক্রির ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে৷ ইইউ-র নাগরিক না হলে এবং কেবল তার নিজের দেশের উদ্দেশে যাত্রাপথ না হলে আইএস-এর সদস্যদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে প্রবেশের ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে৷
ফিলিস্তিনের ইসলামিস্ট জঙ্গি গোষ্ঠী হামাসের নামও রয়েছে এই তালিকায়৷ লেবাননের হেজবুল্লাহ (সামরিক শাখা), সিরিয়ার কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে), শ্রীলঙ্কার লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম (এলটিটিই), কলম্বিয়ার এহেরসিতো দে লিবেরাসিওন নাসিওনাল (ইএলএন), কমিউনিস্ট পার্টি অব দ্য ফিলিপাইন্স-এর মতো অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং বিপ্লবী গোষ্ঠীর নামও রয়েছে এই তালিকাতে৷
তবে ইরানের রেভোলিউশনারি গার্ডকে সন্ত্রাসবাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হলে এটি হবে জোটের একটি অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত৷ এই প্রথম কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে চিহ্নিত করা হবে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসাবে৷ অবশ্য আইআরজিসি এর সদস্যদের কয়েকজনের নাম এরই মধ্যে এই তালিকায় রয়েছে৷ ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা ডিরেকটরেট ফর ইন্টার্নাল সিকিউরিটিও রয়েছে তালিকায়৷
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর কাউন্টার টেরোরিজম এর তানিয়া মেহরা অবশ্য মনে করেন, এই তালিকায় নাম উঠলেও বাড়তি কোনো আর্থিক সমস্যায় ফেলবে না আইআরজিসিকে৷ এরই মধ্যে নানা ইরানের বিরুদ্ধে নানা নিষেধাজ্ঞায় আইআরজিসি এর নাম রয়েছে৷ বরং এর ফলে বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়া ইরানিরা বিপদে পড়তে পারেন বলে মনে করেন তিনি৷ তবে রেভোলিউশনারি গার্ডকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করলে ইরানকে একটি কঠিন বার্তা দেয়া হবে বলে মনে করেন তিনি৷ এর ফলে ইরানের সঙ্গে ইইউ এর কূটনৈতিক সম্পর্কে বড় ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে বলেও আশঙ্কা তার৷
তালিকা থেকে কি নাম বাদ দেয়া যায়?
তালিকায় থেকে নাম কাটানোও সম্ভব৷ তালিকায় নাম ঢোকানোর মতোই এর প্রক্রিয়াও একই৷ কোনো ইইউ সদস্য রাষ্ট্র বা তৃতীয় রাষ্ট্রকে এই প্রস্তাব উত্থাপন করতে হয়৷ ২০১৬ সালে শান্তি চুক্তি করতে রাজি হওয়ায় তালিকা থেকে কলম্বিয়ার বিপ্লবী গোষ্ঠী ফার্ক এর নাম বাদ দেয়া হয়৷
জটিল কিছু ক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইইউ এর বিরুদ্ধে মামলা করারও নজির রয়েছে৷ হামাস নিজেদের বৈধ প্রতিরোধ আন্দোলন দাবি করে ২০১৪ সালে ইইউ এর বিরুদ্ধে মামলা করে৷ ইইউ এর জেনারেল কোর্ট তালিকা থেকে হামাসের নাম বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে রায় দেয়৷ আদালত বলে, হামাসকে তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত সুষ্ঠু তদন্ত ছাড়া কেমন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে নেয়া হয়েছে৷ তবে ২০১৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সর্বোচ্চ আদালত কোর্ট অব জাস্টিস সে রায় পালটে দেয়৷
শোলা লাওয়াল/এডিকে