কান্তনগর: পোড়ামাটির ফলকে ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনি
দিনাজপুর জেলার সুন্দরপুর গ্রামে কান্তজিউ বা কান্তজির মন্দির৷ এটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি তীর্থস্থান৷ পর্যটকদের কাছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবেও এটি সমাদৃত৷ বহিরাবরণজুড়ে অসংখ্য পোড়ামাটির ফলক এর মূল আকর্ষণ৷
কান্তনগর গ্রামে অবস্থান
দিনাজপুর শহর থেকে ২১ কিলোমিটার দূরে কান্তনগর গ্রামে অবস্থিত কান্তজিউ মন্দির৷ অনেকের মতে, কান্তনগরে স্থাপিত বলে এর নাম কান্তজিউ মন্দির৷ জনশ্রুতি আছে, শ্রী-কৃষ্ণের বিগ্রহ অধিষ্ঠানের জন্য এ মন্দির নির্মিত হয়েছিল৷ মন্দিরটি হিন্দু ধর্মের কান্ত বা কৃষ্ণের মন্দির হিসেবে পরিচিত, যা লৌকিক রাধা-কৃষ্ণের ধর্মীয় প্রথা হিসেবে বাংলায় প্রচলিত৷
জমিদার প্রাণনাথ রায় ও পুত্র রামনাথ রায়
দিনাজপুরের তৎকালীন জমিদার প্রাণনাথ রায় ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে পোড়ামাটির অলঙ্করণ সমৃদ্ধ এ মন্দিরটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন৷ তবে তাঁর জীবদ্দশায় নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি৷ পরে ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে তাঁরই পালক পুত্র রামনাথ রায় মন্দিরের নির্মাণ কাজ শেষ করেন৷ এর পরে তিনি এ মন্দিরটি শ্রী কৃষ্ণের উদ্দেশে উৎসর্গ করেন৷
নয়াবাদ মসজিদ
কান্তজিউ মন্দির থেকে মাইলখানেক পশ্চিমে রয়েছে ঐতিহাসিক নয়াবাদ মসজিদ৷ তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদটিও কান্তজিউ মন্দিরের সমসাময়িককালেই নির্মিত বলে মনে করা হয়৷ জনশ্রুতি আছে, কান্তজিউ মন্দির নির্মাণের শিল্পীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন মুসলিম৷ দীর্ঘ সময় জায়গাটিতে বসবাস করায় প্রার্থনার জন্য তারা এ মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন৷
রথের আকৃতি
প্রায় ৩ ফুট উঁচু এবং ৬০ ফুট বাহু বিশিষ্ট প্রস্তর নির্মিত বর্গাকৃতি সমান্তরাল জায়গার উপর মন্দিরটি দণ্ডায়মান৷ সৌধ পরিকল্পনায় মন্দিরটি তিন ধাপে নির্মিত৷ দেখতে অনেকটা বড় আকারের রথের মতো৷
দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ
তিনতলা বিশিষ্ট এবং বর্গাকারে নির্মিত এ মন্দিরের প্রত্যেক দিকের দৈর্ঘ্য ৫২ ফুট এবং উচ্চতা ৭০ ফুট৷ ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে কিছু অংশ ভেঙে যাওয়ায় উপরের গম্বুজ ঘরের আকৃতি ধারণ করেছে৷ ভূমিকম্পে ভেঙে যাওয়ার আগে গম্বুজ ঘরের উপরে ৯টি সুদৃশ্য চূড়া ছিল৷
ঘরের ভেতর ঘর
মন্দিরটির বারান্দার সামনে ইটের তৈরি দুটি করে স্তম্ভ৷ এই স্তম্ভের সাহায্যে দেয়ালের সঙ্গে প্রত্যেক পাশে সংযুক্ত রয়েছে তিনটি করে খোলা দরজা৷ দ্বিতীয় তলার দক্ষিণ পাশের দরজা দু’টি বেশি লক্ষ্য করা যায়৷ এই দরজার পরে, ভেতরে মূল কক্ষটি, সেখানে আছে মোট ১৮টি কক্ষ৷ বড় কক্ষগুলোর চারিদিকে আছে ছোট ছোট ছোট কক্ষ৷
পোড়ামাটির লক্ষাধিক ছবি
কান্তজিউ মন্দিরের বেদির নিচে এবং দেয়ালের গায়ে পোড়ামাটির প্রায় লক্ষাধিক ছবি রয়েছে৷
টেরাকোটার অপূর্ব কারুকাজ
মন্দিরের দেয়ালে দেয়ালে বিভিন্ন মূর্তির টেরাকোটাও রয়েছে৷
রকমারি ছবি
এসব টেরাকোটার মধ্যে নারী-পুরুষ, দেবতা ও কিন্নর, গায়ক ও বাদক, যোদ্ধা ও শিকারী, গৃহিনী, নৌকার মাঝি, নৃত্যরতা রমণী, পালকি বাহক, গাছ-পালা, ফল ও ফুল, লতা-পাতা ইত্যাদির ছবি মূর্তমান৷
পৌরাণিক কাহিনি ও ইতিহাস
রাম-রাবনের যুদ্ধ, হনুমানের লঙ্কায় আগুন দেয়া, মোগল বাদশাহ আকবরের আমলের যুদ্ধের কাহিনিও ফুটে উঠেছে টেরাকোটায়৷
রাস উৎসব
কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর গোপীদের নিয়ে বৃন্দাবনে রাস উৎসবে মেতে উঠতেন৷ সেই ধারা অনুসারে ১৭৫২ সালে মন্দির নির্মাণের পর থেকে কান্তনগর মন্দিরে রাস উৎসব এবং মাসব্যাপী রাস মেলা অনুষ্ঠিত হয়৷
বিদেশি পর্যটক
বাংলাদেশে ভ্রমণে আসা বেশিরভাগ বিদেশি পর্যটক তাদের ভ্রমণ গন্তব্যের তালিকায় কান্তজিউ মন্দিরকে রাখেন৷
ঢেপা নদী
কান্তজিউ মন্দিরের পূর্ব পাশ থেকে বয়ে চলা একসময়ের প্রমত্তা ঢেপা নদী৷ সময়ের বিবর্তনে এ নদী এখন মরা খাল৷
ছবির মতো গ্রাম
কান্তনগর গ্রামটি ছবির মতোই সুন্দর৷ এখানকার গ্রাম, গ্রামের মানুষ আর তাদের জীবনযাত্রাও অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ৷