অবহেলা ও আইনি গেরোয় হারাচ্ছে ইতিহাস
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩রাজ্য হেরিটেজ কমিশন পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যশালী ভবনকে চিহ্নিত করে। এর মধ্যে রয়েছে বিশিষ্ট শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতি জগতের মানুষদের স্মৃতিধন্য বাড়ি। এই বাড়িগুলি ঐতিহ্যশালী ভবনের তকমা পেলেও ঠিকঠাক রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। এর ফলে কোনো বাড়ি ভগ্নস্তূপ হয়ে উঠেছে।
এই বছর কবি মধুসূদন দত্তের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। খিদিরপুরে তার বাড়ি ভাঙা হতে পারে বলে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। এখানে তৈরি হতে পারে শপিং মল। অথচ এই বাড়ি থেকেই কবির স্কুল, কলেজের পড়াশোনা, কবিতা লেখার শুরু।
একইভাবে 'নীলদর্পণ' খ্যাত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের উত্তর ২৪ পরগনার চৌবেড়িয়া গ্রামের বাড়ি হেরিটেজ ঘোষিত হওয়া সত্ত্বেও সংস্কারের অভাবে ধুঁকছে।
প্রথম ভারতীয় নারী চিকিৎসক কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি ছিল ১৩এ বিধান সরণীতে। সেই বাড়ির জায়গায় অন্য নির্মাণের ছাড়পত্র আগেই দিয়েছে হেরিটেজ কমিশন।
নাট্যকার গিরীশ ঘোষের বাগবাজারের বাড়িটিকে থাকলেও তার করুণ অবস্থা। অভিনেত্রী নটি বিনোদিনীর বাড়ি ও তার সামগ্রী অক্ষত থাকলেও রয়েছে ব্যক্তি মালিকানায়। সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে রাজ্যের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের বাড়ির উপরের তলগুলির অবস্থা কার্যত গুদামের মতো।
এ সব হতাশার ছবির মধ্যে রুপোলি রেখা দেখা যাচ্ছে বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী যামিনী রায়ের বাড়িকে ঘিরে। চিত্রশিল্পকে মধ্যবিত্তের গেরস্থালির ভেতর পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্ব তাঁরই। সূত্রের খবর, দিল্লি আর্ট গ্যালারি এই বাড়ি কিনে নিচ্ছে। সেখানেই গড়ে উঠবে সংগ্রহশালা। দক্ষিণ কলকাতার বন্ডেল রোডের কাছে রাস্তার নাম যামিনী রায় সরণী। সেখানে ১৮/৩৯ নম্বর বাড়িটি প্রয়াত শিল্পীর।
১৯৭২ সালে শিল্পী প্রয়াত হন। এই বাড়ি তার পরিবাবের কাছ থেকে নিচ্ছে দিল্লির সংস্থাটি। সূত্রের খবর, অনেক আগেই এই সংক্রান্ত চূড়ান্ত বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছে। সেই সিদ্ধান্ত এবার কার্যকর হতে চলেছে। এই বাড়ি হস্তান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে কলকাতা পুরসভার ঐতিহ্য সংরক্ষণ কমিটি।
শহরের আনাচে কানাচে ৩৫০টি এমন ঐতিহ্যবাহী বাড়ি রয়েছে, যেগুলিকে ঐতিহ্যশালী তকমা দিলেও কোনো গ্রেড দেয়া হয়নি। এবার হেরিটেজের নিয়ম মেনে সেগুলিকে গ্রেড দেওয়া হবে বলে কলকাতা পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে। কিন্তু এগুলি সংরক্ষণের পথে বাধা সেই আইনের গেরো।
দীর্ঘদিন রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যান পদে ছিলেন চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "কোনো কাজ করতে হলে আইনি জটিলতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। একটি সম্পত্তির অনেক শরিক থাকে। যারা দাবিদার তাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়।"
মধুকবির বাড়ি সম্পর্কে তিনি বলেন, "যিনি মধুসূদনের বাড়ি কিনেছেন, তার বক্তব্য এটি কবির প্রমাণ দিতে পারলে ২৫ লক্ষ টাকা দেবেন। উনি এই বাড়ি ভেঙে যে নির্মাণই করুন, তা যেন মধুসূদনের নামে হয়, সে ব্যাপারে কথা আদায় করেছি।"
চিত্রশিল্পী সমীর আইচ আঙুল তুলেছেন কমিশনের দিকেই। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "রাজ্যে হেরিটেজ কমিশন আছে বলে মনে হয় না। যেখানে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের ঐতিহ্য লোপাট করে দেওয়া যায়, সেখানে সবই সম্ভব। এটা সারা দেশেই একটা ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে।" সম্প্রতি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রাজনৈতিক দলের কার্যালয় নিয়ে জলঘোলা হয়। গ্রেড ওয়ান হেরিটেজ স্বীকৃতি পাওয়া ভবনের অব্যবহৃত ঘর ভেঙে নির্মাণকাজ চালানোর অভিযোগ উঠেছিল। বিষয়টা গড়ায় আদালত পর্যন্ত।
ঐতিহ্য রক্ষায় ব্যক্তিগত উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছেন কবি সুবোধ সরকার। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "যামিনী রায়ের বাড়িতে যেমন ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগ্রহশালা হচ্ছে, তেমন উদ্যোগ যদি আরো নেওয়া যায়, ভাল হবে। সরকারের পক্ষে এই সব বাড়ি কিনে নিয়ে হস্তান্তরিত করা সম্ভব নয়।"
কলকাতা হেরিটেজ ওয়াকের যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা ড. তথাগত নিয়োগী এই বক্তব্যে সহমত। তিনি বেশি জোর দেন আইন সংস্কারে। ডয়চে ভেলেকে বলেন, "শরিকি বিবাদ যেমন আছে, তেমনই আইনি জটিলতাও রয়েছে। আমাদের হেরিটেজ আইন উনিশ শতকের প্রথম দিকের তৈরি। সেই সময়ের তৈরি আইন এখন আমূল পরিবর্তন না হলে শরিকি বিবাদ মেটানো সম্ভব নয়।"
উপযুক্ত আইন কবে হবে তার জন্য সময় বসে থাকবে না। আর সেই সময়ের গ্রাসেই কি হারিয়ে যাবে ইতিহাস?