আনারের লাশ না পাওয়া গেলেও সংসদের আসন শূন্য হতে পারে?
২৭ মে ২০২৪আজীম ভারতের কলকাতায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে ভারত ও বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চিত করলেও মরদেহ না পাওয়ায় জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। তবে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মরদেহ পাওয়া না গেলেও সরকারের তরফ থেকে মৃত্যু নিশ্চিত করা হলে সংসদ সচিবালয় তার আসন শূন্য ঘোষণা করতে পারে।
সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সব ক্ষেত্রে যে মৃত্যুর পর মরদেহ পাওয়া যাবে, এটা তো নিশ্চিত করে বলা যাবে না। সাগরে যদি জাহাজডুবি হয় বা দুর্গম এলাকায় বিমান দুর্ঘটনা ঘটে তখন অনেক ক্ষেত্রে মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায় না । তাহলে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করা হবে না? সংসদ সদস্য আজীমের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, এখনও তো আইন শৃঙ্খলা বাহিনী মরদেহ খুঁজে পাওয়ার আশা ছেড়ে দেয়নি। তারা তো তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত যদি মরদেহ না পাওয়া যায় তাহলেও কী হবে? যারা তদন্ত করছে, যে ডিবি যদি নিশ্চিত হয় যে, আজীমের মৃত্যু হয়েছে। তাহলে তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন সংসদ সচিবালয়কে জানাবে। তখন সংসদ সচিবালয় থেকে নির্বাচন কমিশনে জানানো হবে।”
আইন অনুযায়ী, কোনো এমপির আসন শূন্য ঘোষণা করতে তার মৃত্যু সনদ লাগে। আনারের মরদেহ না পাওয়া গেলে সেই সনদ দেবেন কে বা কোন কর্তৃপক্ষ? সংসদীয় আসনই বা শূন্য ঘোষণা করা হবে কীভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এক্ষেত্রেও কোনো জটিলতা নেই। কারণ ডিবি তদন্তে যদি নিশ্চিত হয় আজীম সাহেব মারা গেছেন তাহলে তারা আদালতে রিপোর্ট দেবেন। আদালত যদি ডিবির তদন্তে সন্তুষ্ট হয়ে সিদ্ধান্ত দেন যে, আজীম আর বেঁচে নেই, তাহলে আদালতের ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংসদ সচিবালয় আসন শূন্য করতে পারে। মূল কথা হল, আদালত থেকেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসতে হবে।”
কোনো সংসদ সদস্যের মৃত্যুর পর জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে তার আসনটি শূন্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করার কথা। নির্বাচন কমিশনেরও ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু সবার আগে তো মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া জরুরি। অবশ্য সংবিধানের ৬৭ ধারার ১ (খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদের অনুমতি না নিয়ে কোনো সদস্য একনাগাড়ে ৯০ কার্যদিবস সংসদের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকলে ওই সদস্যের আসন শূন্য ঘোষণা করে সংসদ সচিবালয়। এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশনকে জানায় সংসদ। নির্বাচন কমিশন ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচনের আয়োজন করে।
এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কী করবে? জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবীন খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বিষয়টি সম্পূর্ণ সংসদ সচিবালয়ের এখতিয়ার। এটা নির্বাচন কমিশনের বিষয় না। সংসদ সচিবালয় নিশ্চিত হয়ে আসনটি শূন্য ঘোষণা পূর্বক প্রজ্ঞাপন করে পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য নির্বাচন কমিশনে পাঠাবেন। এরপরই নির্বাচন কমিশন উপ-নির্বাচনের আয়োজন করবেন।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেহেতু আজীমের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে শোকবার্তা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সমবেদনা জানিয়েছেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এটিও গুরুত্ব পেতে পারে বলে জানা গেছে। বিষয়টির সুরাহা করতে সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী শিগগিরই বিষয়টি নিয়ে সংসদ নেতা শেখ হাসিনার পরামর্শ গ্রহণ করবেন। সংসদ নেতা এবং সংসদ ও আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নিয়ে সমাধান করবে সংসদ।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. সাখাওয়াত হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "প্রধানমন্ত্রীর শোক বাণীতে কিন্তু সমস্যার সমাধান হবে না। বিষয়টি আইনগতভাবে দেখতে হবে। এখনও এমপি আজীমের মরদেহ পাওয়া যায়নি। ফলে সংসদ সচিবালয় এখনই এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারবে না। নিশ্চিতভাবে তার যে মৃত্যু হয়েছে, এটা কে বলবে? ধরেন তদন্তকারীরা বলল, কিন্তু এক সময় তিনি নিখোঁজ থেকে ফিরে এলেন, তখন কী হবে? ফলে আজীমের সংসদ সদস্য পদ যাওয়ার মতো এখন একটাই প্রক্রিয়া আছে, সেটি হল সংবিধানের ৬৭ ধারার ১ (খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদের অনুমতি না নিয়ে একনাগাড়ে ৯০ কার্যদিবস সংসদের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকা। সেটির জন্যও কিন্তু আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।”
আজীমের সংসদীয় আসন শূন্য ঘোষণার বিষয়ে জানতে চাইলে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, "এ বিষয়ে আমরা এখনই কোনো সিদ্ধান্ত নেব না। আমরা আরও অপেক্ষা করব। কারণ এ ঘটনা খুবই ব্যতিক্রমধর্মী। আমাদের সামনে কোনো নজির নেই। কার্যপ্রণালি বিধিতেও এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই।”
এর আগে হত্যাকাণ্ডের শিকার এমপিদের প্রসঙ্গ টেনে স্পিকার বলেন, "তাদের হত্যার পর মরদেহ পাওয়া নিয়ে কোনো জটিলতা হয়নি এবং জানাজা হয়েছে। সেই হিসেবে তাদের আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন সরকারের পক্ষ থেকে না জানালেও সংসদ নিশ্চিত হয়েছিল যে তারা মারা গেছেন। কাজেই সেসব ঘটনার সঙ্গে এটিকে মেলানোর কোনো সুযোগ নেই। এখানে সমস্যা হচ্ছে, তার দেহ পাওয়া যায়নি। ওনার মৃত্যুসনদ বা কোনো কাগজ আমাদের কাছে আসতে হবে। শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। ফলে এ বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে, আলোচনা চলছে। আগামী ৫ জুন সংসদ অধিবেশনের আগে কার্য-উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক হবে, সেখানে আলোচনা করা হবে। ওই বৈঠকে কমিটির সদস্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও উপস্থিত থাকবেন।” বাজেট অধিবেশন শুরুর আগেই বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া যাবে বলেও আশা করেন স্পিকার।
জানা গেছে, অতীতে এমন নজির না থাকায় সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি নিয়ে টানাপোড়েনে রয়েছেন। আওয়ামী লীগের এমপি ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমীর হোসেন আমু ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এটা নিয়ে খুব বেশি জটিলতা আমি দেখছি না। সমস্যা তো হয়েছে, তার লাশ পাওয়া যাচ্ছে না। এতে কোনো সমস্যা নেই। তদন্তকারীরা যদি তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন তাহলেই সংসদ সচিবালয় আসন শূন্য ঘোষণা করতে পারে। এতে কোনো বাধা নেই।”