আমাদের কমলা রঙের টেলিফোন
৬ মার্চ ২০১৮একদিন আন্দাজে ডায়াল ঘুরিয়ে ফোন করলাম৷ ওপাশ থেকে আমারই বয়সি এক কিশোরীর সুকণ্ঠ৷ স্বীকার করছি, সেদিন ঘাবড়ে গিয়েছিলাম৷
- হ্যালো, স্লামালাইকুম৷
- ওয়ালাইকুম আসসালাম৷ ভালো আছো? (যতটা সম্ভব গলা ভারী করার চেষ্টা করলাম)
- জ্বি ভালো৷ কে বলছেন?
- ভালো থেকো সবসময়৷ রাখি?
- জ্বি?
খটাস করে ফোন রেখে দিলাম৷ ঐটুকু দুষ্টুমিই তখন কী যে মজা লাগতো! পরে স্কুলে যখন খুব বন্ধুবান্ধব জুটে গেল, তখন তাদের সঙ্গে কথা হতো ঐ ফোনেই৷ কারো কারো বাসায় কথা বলার বাধ্যবাধকতা থাকলে টিঅ্যান্ডটি ফোনেই মিসকল দিতাম৷ একবার রিং করে কেটে দেয়ার ঘটনা তিনবার ঘটলে ওপাশ থেকে নিশ্চিত হয়ে যাওয়া যেত যে কে কল দিয়েছে!
স্কুলজীবনের শেষ দিকে বা কলেজের শুরুর দিকে মোবাইল ফোন এলো৷ আমার তখনো মোবাইল ফোন নেই৷ বন্ধুদের দু-একজনের ছিল৷ আমরা দোকান থেকে দশ টাকা মিনিটে কল করতাম৷
অল্প কথায় কাজ শেষ হয়ে গেলে বাকি কথার জন্য আফসোস হতো৷ আবার কোনো কারণে এক মিনিট পার হয়ে গেলে কয়েক সেকেন্ডের জন্য আরো দশ টাকা গুনতে হতো!
একবার ফোন অপারেটররা কী করল, প্রথম তিন সেকেন্ড ফ্রি করে দিলো৷ আর যায় কোথায়! কথা হতো ঐ তিন সেকেন্ডে৷ একবার এই বন্ধু ফোন করছে ঐ বন্ধুর কাছে, ‘‘কোথায়?'' বলেই ফোন কেটে দিলো৷ এরপর অন্য বন্ধুর কল, ‘‘মেইন গেটে৷'' এভাবেই চলতো৷
এর পরের কয়েক বছরে মোবাইল ফোনের ব্যবহার অনেকটাই বদলে গেল৷ কলরেট কমে গেল৷ মেসেজের দাম কমলো৷ এমনকি মোবাইল ফোনের দামও কমে গেল৷
এক সময় ফিলিপ্সের সেই ডিগা সেট, যা দিয়ে ক্রিকেট পর্যন্ত খেলা যেত বলে প্রচলন ছিল, সেই সেট ছোট হতে লাগলো৷ নোকিয়া সি২৫, এ৩৫ আর ৩৩১০ আজ কেবল নস্টালজিকই করে দেয়৷ আরো ছিল, মোটোরোলা, সাজেম কত কী!
পরের এক দশকে সব যেন হুট করে বদলে গেল৷ সবার হাতে মাল্টিমিডিয়া হ্যান্ডসেট৷ তখন ফোনে কথা বলার চেয়ে ছবি তোলা, ভিডিও করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকলো৷
মোবাইল ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও গতি সব দ্রুতগতিতেই বদলে দিতে লাগল৷ এখন খুব বেশি কেউ বাসার টিঅ্যান্ডটি সংযোগ নিয়ে ভাবে না৷
মোবাইল এখন শুধু কথা বলার যন্ত্র নয়৷ হরেক রকম যোগাযোগের একটি ডিভাইস, যার মূল চালিকাশক্তি হয়ে গেছে ইন্টারনেট৷
যেমন সেদিনও ডয়চে ভেলের বার্লিন অফিস থেকে আসা এক সহকর্মী ফিলিপ বলছিল,
- তোমার নম্বর দাও৷
আমি নম্বর দিলাম৷ সে বলল,
- হোয়াটসঅ্যাপে খুঁজে পাচ্ছি না৷
- হোয়াটসঅ্যাপে তো এই নম্বর ব্যবহার করি না৷ হোয়াটসঅ্যাপের নম্বর হলো...
সে হেসে বলল,
- হোয়াটসঅ্যাপের নম্বরটাই বেশি দরকার৷
এখন মানুষ কথা বলতে বা টেক্সট পাঠাতে মোবাইলের ক্রেডিট খরচ না করে হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, লাইন, ইমো – এ সব ব্যবহার করে৷
শুধু তাই নয়, মোবাইল ব্যাংকিং বা লেনদেন এখন সমধিক জনপ্রিয়৷ বিশেষ করে নগদ অর্থ লেনদেনে বাংলাদেশে ‘বিকাশ' যা করেছে, তা সারাবিশ্বে এখন রোল মডেল৷
এর বাইরে মোবাইল ওয়ালেট অ্যাপগুলো বাংলাদেশে ততটা জনপ্রিয় না হলেও বিশ্বের অনেক জায়গাতেই এই সেবাগুলো জনপ্রিয় ও নিরাপদ বলেই মানা হয়৷
তাই মোবাইল অপারেটররাও এখন বেশি গুরুত্ব দেয় ইন্টারনেট অবকাঠামো সম্প্রসারণে, যার সাম্প্রতিক উদাহরণ ফোর জি৷ ফোর জি-র লাইসেন্স বিক্রি করে বাংলাদেশ কামিয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৩শ' কোটি টাকা৷
অপারেটররা জানে যে, ইন্টারনেটের গতি বাড়লে এর ওপর নির্ভরশীলতা আরো বাড়বে৷ আরো নতুন নতুন প্লাটফর্ম তৈরি হবে৷ তাই তারা এখানে বিনিয়োগ করছে৷
হিসেব বলছে, অপারেটররা এখন পর্যন্ত এক লাখ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছে বাংলাদেশে৷
এর আগে, ২০১২ সালে বাংলাদেশের মানুষ থ্রি জি প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়েছে৷ থ্রি জি প্রযুক্তি বাংলাদেশে আসার মাত্র তিন বছরের মধ্যে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪ কোটি পেরিয়ে যায়৷
২০০৯ সাল থেকে বাড়তে থাকে এ খাতে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগও৷ তুলনামূলকভাবে অবশ্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ খাতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে৷ অপারেটররা এখন লাভ বেশি করলেও বিনিয়োগের হার কমিয়ে দিচ্ছে৷ অথচ অনেক জায়গাতেই সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ তাই বিষয়টি কর্তৃপক্ষের দেখা দরকার৷
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি-র সর্বশেষ হিসেব দেখাচ্ছে, গত বছর ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে মোবাইল সংযোগ ব্যবহৃত হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি৷ এর মধ্যে গ্রামীণফোন প্রায় সাড়ে ছয় কোটি এবং রবি প্রায় চার কোটি ত্রিশ লাখ সংযোগ বিক্রি করেছে৷
ইন্টারনেটের প্রায় আট কোটি সংযোগ আছে, যার সাড়ে সাত কোটিই মোবাইলের মাধ্যমে ব্যবহার করছেন মানুষ৷ বাকি ৫০ লাখ মূলত আইএসপি ও পিএসটিএন৷ এর বাইরে কিছু ওয়াইম্যাক্স সংযোগ আছে৷
এর অর্থ দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ এখনো ইন্টারনেট সংযোগের আওতার বাইরে আছে৷ তার মানে, এখনো ইন্টারনেটের বিরাট বাজার পড়ে আছে৷ আর যেহেতু ইন্টারনেট মূলত মোবাইলেই ব্যবহৃত হয়, তাই মোবাইল অপারেটররা এ খাতে বিনিয়োগ করবেন, এটাই স্বাভাবিক৷
মূল কথা হলো, টেলিযোগাযোগ খাতে বাংলাদেশের অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে৷ এই অগ্রগতির হার জ্যামিতিক হারে বেড়েছে৷ ফোর জি এলে সেই গতি আরো বাড়বে বলে আশা করা যায়৷
কিন্তু যোগাযোগ বা লেনদেন, কিংবা গবেষণা যে সুবিধার কথাই বলা হোক না কেন, অবকাঠামো ও সেবার মান যত ভালো হবে, সার্বিকভাবে উন্নয়নের মানও ভালো হবে৷ তাই সেদিকেই বেশি জোর দিতে হবে৷
মোবাইল ইন্টারনেট আপনাকে কী কী সুবিধা দিয়েছে? লিখুন মন্তব্যের ঘরে৷