1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আরজি করে নির্যাতিতার পরিবারের হতাশা কেন বাড়ছে?

১২ ডিসেম্বর ২০২৪

আরজি করে চিকিৎসক খুনের পর কেটে গিয়েছে চার মাস। তদন্ত থেকে বিচার, সব কিছুই চলছে শ্লথ গতিতে। আন্দোলনের চাপ সরে যেতেই কি ঢিলেমি? এই পরিস্থিতিতে নির্যাতিতার পরিবারের হতাশা বেড়েছে।

https://p.dw.com/p/4o2ic
কলকাতায় কুমোরটুলিতে নির্যাতিতার বিচারের দাবিতে পোস্টার।
কেন হতাশা প্রকাশ করেছে আরজি করে নির্যাতিতার পরিবার?ছবি: Payel Samanta/DW

গত ৯ অগাস্ট আরজি করমেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হয়। এই ঘটনার সঠিক তদন্ত চেয়ে জুনিয়র চিকিৎসক থেকে নাগরিক সমাজ প্রতিবাদে সরব হয়েছিল। দিনের পর দিন আন্দোলন চলেছে। কিন্তু ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে দেখা যাচ্ছে, তদন্ত থেকে বিচার, সবকিছুর মধ্যেই একটু দীর্ঘসূত্রিতার ভাব রয়েছে।

সরলেন আইনজীবী

দেশের প্রথম সারির আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার ও তার সহযোগীরা নিহত চিকিৎসকের পক্ষে সওয়াল করছিলেন আদালতে। কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই তারা সর্বোচ্চ আদালত, কলকাতা হাইকোর্ট, শিয়ালদহ দায়রা আদালত ও এসিজেএম আদালতে আইনি লড়াই চালাচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎই বৃন্দা এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন।

যদিও এ ব্যাপারে নিহত চিকিৎসকের অভিভাবকরা কিছু জানেন না। বৃন্দার পক্ষ থেকে সরাসরি তাদের কিছু জানানো হয়নি। তবে জুনিয়র চিকিৎসকদের দাবি, এতে আইনি লড়াইয়ে সমস্যা হবে না। নিম্ন আদালতে অন্য আইনজীবীরা নিহত চিকিৎসকের বাবা-মায়ের প্রতিনিধিত্ব করবেন। 

চিকিৎসক সংগঠন ওয়েস্টবেঙ্গল ডক্টর্স ফোরামের সভাপতি তথা ছ'টি চিকিৎসক সংগঠনের যৌথ মঞ্চের অন্যতম কর্তা কৌশিক চাকী ডিডাব্লিউকে বলেন, "নির্যাতিতার বাবা মা আইনি গতি প্রকৃতি নিয়ে কিছুটা হতাশা প্রকাশ করেছেন মিডিয়ার কাছে। তবে আমরা হতাশ নই, আমরা শেষ পর্যন্ত দেখে ছাড়ব। শিয়ালদা কোর্টে বিচারের জন্য নতুন আইনজীবীর দল নির্যাতিতার বাবা-মার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে যেহেতু বৃন্দা গ্রোভার নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন, এ বার জয়েন্ট প্লাটফর্ম অফ ডক্টরস-এর আইনজীবী করুণা নন্দী মামলা লড়বেন। হাইকোর্টে এই জায়গায় কে দাঁড়াবেন সেটা নিয়ে আমরা আলোচনার মধ্যে আছি। নির্যাতিতার মা-বাবা যাতে সুবিচার পান, সে জন্য আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি।"

শুনানিতে দীর্ঘ বিরতি

সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি পদে দায়িত্ব নেয়ার পর সঞ্জীব খান্না প্রথমবার আর জি কর মামলার শুনানি করেছেন। মঙ্গলবারের শুনানিতে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন করেন প্রধান বিচারপতি। সিবিআই জানিয়েছে, নিম্ন আদালতে দ্রুত সেই প্রক্রিয়া চলছে। চার্জশিট পেশের পর চার্জ গঠন করা হয়েছে। ৪৩ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। 

সর্বোচ্চ আদালতে সিবিআইয়ের দাবি, মাসখানেকের মধ্যে শিয়ালদা আদালতে বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যাবে। এতে সন্তুষ্ট হচ্ছেন না নির্যাতিতা চিকিৎসকের মা-বাবা। তাদের দাবি, বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে তারা অন্ধকারেই রয়েছেন। বিভিন্ন বিষয়ে তাদের জানানোর কথা বললেও তারা কিছুই জানতে পারছেন না।

সুপ্রিম কোর্টে আর জি কর মামলার পরের শুনানি ১৭ মার্চ। অবশ্য তার আগে বিশেষ প্রয়োজনে সর্বোচ্চ আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। অর্থাৎ আরও তিন মাসের বেশি সময়ের পরে শুনানি। এতে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে আন্দোলনকারীদের। দ্রুত বিচার চেয়ে কলকাতার রাজপথ আন্দোলিত হয়েছিল। তখন সর্বোচ্চ আদালতে শুনানিও হচ্ছিল ঘন ঘন। চিকিৎসকদের একাংশের প্রশ্ন, তাহলে কি আন্দোলন স্তিমিত হতে তদন্ত প্রক্রিয়াতেও ঢিলেমি দেখা যাচ্ছে?

জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে ডাঃ অর্ণব তালুকদার ডিডাব্লিউকে বলেন, "এই টালবাহানা নিয়ে আমরা প্রথম থেকেই অসন্তুষ্ট। আমরা প্রথম থেকেই চেয়েছিলাম যাতে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে বিচার হয়। এই মুহূর্তে আমরা টানা রাজপথে নেই। আমাদের সিনিয়ররা পরীক্ষা দিচ্ছে, আন্ডারগ্রাজুয়েট-এর বিভিন্ন ব্যাচ পরীক্ষা দিচ্ছে। এই সুযোগে দেখা গেল সুপ্রিম কোর্টের শুনানি প্রায় তিন মাস পিছিয়ে গেল। তাহলে কি আমরা আন্দোলন করছিলাম বলে তার চাপেই কি ১০-১৫ দিন অন্তর সুপ্রিম কোর্টে শুনানি চলছিল। সুপ্রিম কোর্টে যদি আমরা দ্রুত শুনানি চাই, তাহলে কি আবার আমাদের কর্মবিরতিতে নামতে হবে? এটা আমাদের আবার ভেবে দেখতে হবে! প্রয়োজনে সে রকম পদক্ষেপ নেব।"

যদিও জুনিয়র ডাক্তারদের বক্তব্যে যৌক্তিকতা দেখছেন না বর্ষীয়ান আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "সুপ্রিম কোর্টের এখানে কিছু করার নেই, আমি প্রথম দিন থেকে এটা বলে আসছি। যেদিন সুপ্রিম কোর্ট বলে দিয়েছে, আমরা সিবিআই এর তদন্তে হস্তক্ষেপ করছি না, তখনই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের কিছু করার নেই। সর্বোচ্চ আদালত কিছু করতেও পারবে না।"

অভিভাবকদের হতাশা 

আরজি করে নিহত চিকিৎসকের অভিভাবকরা এই আন্দোলনে গোড়া থেকেই রাস্তায় রয়েছেন। তারা জুনিয়র চিকিৎসকদের অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন। দুর্গাপুজোর সময় ধরনায় বসেছিলেন নিজেদের পাড়ায়। এখন জুনিয়র চিকিৎসকরা কাজে ফিরে গিয়েছেন। সবমিলিয়ে হতাশায় ডুবে যাচ্ছেন নির্যাতিতার মা-বাবা।

এই টালবাহানা নিয়ে আমরা প্রথম থেকেই অসন্তুষ্ট: ডা. অর্ণব তালুকদার

সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে তারা বলেছেন, "আমরা ভেবেছিলাম মেয়ের দ্রুত বিচার পাব। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে শুনানি হবে তিন মাস পর। সিবিআই-এর তদন্তে নজরদারি করছে সর্বোচ্চ আদালত। সিবিআই আদালতে যা বলছে, তার সঙ্গে কাজের মিল থাকছে না। শিয়ালদা আদালতে চার্জশিট জমা দেয়ার আগে আমরা জানতে পারিনি। আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে না।"

সিবিআই চলতি সপ্তাহে শিয়ালদা আদালতে জানিয়েছে, তারা ৯০০ ঘন্টার ফুটেজ খতিয়ে দেখছে। আটটি জায়গার আটটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে। এতদিনে কেন ফুটেজ দেখার কাজ সম্পূর্ণ হল না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ নিয়ে সওয়াল করেছেন একাধিক অভিযুক্তের আইনজীবী।

সাবেক পুলিশ কর্তা নজরুল ইসলাম ডিডাব্লিউকে বলেন, "সিবিআইয়ের কিছুটা সময় লাগার কথা। যেহেতু প্রথম মামলাটার তথ্য লোপাট করা হয়েছে। কিন্তু সে সময়েরও তো একটা সীমা থাকা উচিত। সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার ওসি অভিজিৎ মন্ডলের বিরুদ্ধে তারা চার্জশিট দিতে চেয়েছে, রাজ্য সরকারের অনুমোদন চেয়েছে। সেটা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে কি রিপোর্ট দিয়েছে, সেটা আমি জানি না। রিপোর্টে পেয়ে সর্বোচ্চ আদালত খুশি। সিবিআই কী করেছে সেটা না জেনে মন্তব্য করা মুশকিল।"

বিচারের অপেক্ষায় চার মাস

এত কিছুর পরেও হাল ছাড়তে নারাজ নির্যাতিতার পরিবার। নিহত চিকিৎসকের মা বলেন, "বিচার ব্যবস্থার উপর ভরসা রাখা ছাড়া আমাদের কোন উপায় নেই! আশা করছি নিরপেক্ষ বিচার হবে। খুনি সাজা পাবে।"

জয়নগরে ধর্ষণ ও খুনের মামলায় তদন্তের পর দ্রুত সাজা ঘোষণা হওয়ায়আরজিকরের বিচার নিয়ে প্রশ্ন আরো জোরালো হয়েছে। নির্যাতিতার বাবা-মায়ের অসন্তুষ্ট হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বলে মনে করেন নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, "জয়নগরের মামলায় তদন্ত হয়ে নিম্ন আদালতে সাজা ঘোষণা হয়ে গেল। এখন হাইকোর্টে যা হবার হবে। আর জি কর মামলা তারও আগেকার। ফলে নির্যাতিতার বাড়ির লোকের অসন্তুষ্ট হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।"

তিনি বলেন, "পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে এটা বুঝতে হবে যে কারো নামে চার্জশিট দিতে গেলে তার বিরুদ্ধে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ পেতে হবে। কোনো একজন অপরাধ করলেও তার বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া না গেলে চার্জশিট দেওয়া যায় না।"

অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরসের সাধারণ সম্পাদক, চিকিৎসক উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায় ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমরা এখনো চাই দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বৃহত্তর দুর্বৃত্ত চক্রকে আওতায় আনা হোক। হেফাজতে যারা আছেন, তারা সরকারি কর্মচারী। তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দিতে গেলে রাজ্য সরকারের অনুমতিপত্র লাগে,  সেই অনুমতি এখনো দেয়া হয়নি। রাজ্য প্রশাসনের কাছে আমরা দাবি জানিয়েছি, অবিলম্বে সিবিআইকে সেই অনুমতি দেয়া হোক, যাতে পুরোপুরি চার্জশিট জমা দিতে পারে তারা।"

আইনজীবী বিকাশ রঞ্জনের বক্তব্য, "একজন মানুষকে সাজা দিতে গেলে প্রথমে ট্রায়াল চলবে, তাতে সাক্ষ্য প্রমাণের দরকার। নিম্ন আদালতে তদন্ত হবে। যে সাক্ষ্য প্রমাণ তদন্তকারী সংস্থা জোগাড় করবে, তার ভিত্তিতে যে অভিযুক্ত তাকে সুযোগ দিতে হবে, তারপর বিচার হবে। সেই বিচারটা একমাত্র নিম্ন আদালতেই হয়। তারপর সেখান থেকে আপিল হলে পরে সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারে, সেটা ভিন্ন। এই অবস্থায় শীর্ষ আদালতের কিছু করার নেই। অকারণে মানুষ সুপ্রিম কোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট বলে লাফালাফি করছে।"

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷