ইউরোপে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের অভিন্ন গ্রিডে বাধা কোথায়?
১৭ জুন ২০২৪
ইউরোপীয় কমিশনের ভবিষ্যৎ নীতি নির্ধারণে সদ্য সমাপ্ত পার্লামেন্ট নির্বাচন কতটা প্রভাব রাখবে সেটি এখনও পরিষ্কার নয়৷ এ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু নিরপেক্ষ হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন ঘিরে একটি অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে৷
ইউরোপের এই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে একটি বিষয় অনিবার্য৷ আর তা হলো নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন৷ এই অঞ্চলের কিছু দেশ পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিকভাবে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত৷ কিন্তু তার থেকে গোটা ইউরোপের সুবিধা পেতে জ্বালানি কোম্পানিগুলোকে নতুন প্রযুক্তিনির্ভর অভিন্ন ইলেক্ট্রিক গ্রিড গড়ে তুলতে হবে৷ এস্তোনিয়ান আইনপ্রণেতা কাদরি সিমসন বলেন, ‘‘ইউরোপের বিদ্যুৎ অবকাঠামো এরইমধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে৷ আমরা বিভিন্ন খাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে চাই৷ এজন্য উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে৷ এর অর্থ হলো আমাদের বিদ্যুৎ গ্রিডকে উন্নত করতে হবে যাতে আরো নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের যোগান দেয়া যায়৷''
শীতে বায়ু, গ্রীষ্মে সৌর শক্তি
পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় দেশগুলোর আলাদা আলাদা সক্ষমতা রয়েছে৷ উত্তরাঞ্চল ও বাল্টিক অঞ্চলে বায়ু থেকে প্রচুর বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়৷ অন্যদিকে দক্ষিণাঞ্চল সৌর বিদ্যুতের জন্য আদর্শ৷ জার্মানির কম্পিটেন্স সেন্টার এনার্জি টেকনোলজি অ্যান্ড এনার্জি সিস্টেমস নামের একটি সংস্থার প্রধান হারাল্ড ব্রাডকে বলেন, ‘‘সৌর বিদ্যুৎ ও বায়ু বিদ্যুৎ একে অপরের পরিপূরক৷ বায়ু শক্তির মাধ্যমে শীতকালে প্রচুর বিদ্যুৎ পাওয়া যায়৷ আবার সৌর বিদ্যুৎ গ্রীষ্মে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে৷''
কীভাবে এই বিদ্যুৎ মজুত করা যায়? ভৌগলিক অবস্থান ভেদে তার ব্যবস্থাও আলাদা৷ ‘পাম্পড হাইড্রোইলেক্ট্রিক এনার্জি স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি' এক্ষেত্রে বড় আকারের ব্যাটারি হিসেবে কাজ করে৷ এই পদ্ধতিতে চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করে পাহাড়ের উপরে কোনো সংরক্ষণাগারে জল তোলা হয়৷ আবার যখন বিদ্যুতের প্রয়োজন পড়ে তখন টারবাইনের মধ্যে দিয়ে সেই জল ছেড়ে দেয়া হয়৷ এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়৷ স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও আল্পাইন অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে এই সুবিধা রয়েছে৷
প্রয়োজন আরো বৈদ্যুতিক লাইন
ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য বৈদ্যুতিক লাইনের সংযোগ বাড়াতে হবে৷ ব্রাডকের মতে, এতে বিদ্যুতের খরচ কম পড়বে৷ কেননা যেখানে সবচেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে, সেখান থেকে বিদ্যুৎ অন্য দেশে সরবরাহ করা যাবে৷ এর ফলে ব্যায়বহুল বিকল্প বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও আর তৈরি করে রাখতে হবে না৷ প্রাকৃতিক গ্যাস নির্ভর এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র সারা বছর অলস পড়ে থাকলেও চাহিদা বেশি থাকে অল্প কয়েক দিনের জন্য সচল করতে হয়৷ এতে উৎপাদনের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়৷
কিন্তু অভিন্ন ইলেক্ট্রিক গ্রিড নির্মাণ সম্ভব হলে গোটা ইউরোপের মধ্যে বিদ্যুৎ সঞ্চালন সম্ভব হবে৷ যেখানে খরচ কম বা উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় সেখান থেকে বেশি চাহিদা থাকা অঞ্চলে বিদ্যুৎ পাঠানো যাবে৷ ব্রাডকের মতে, এর ফলে সবাই উপকৃত হবে৷ আর তার জন্য সবার আগে বৈদ্যুতিক লাইনের পরিমাণ বাড়াতে হবে৷
বাধা কোথায়
জার্মানিতে এ ধরনের বৈদ্যুতিক লাইন বসানোর ক্ষেত্রে টাকা কোনো সমস্যা নয়৷ বরং মানুষ সঞ্চালন লাইনের আশেপাশে বসবাস করতে চান না৷ তাদের আশঙ্কা এতে নিজেদের সম্পদ ও স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে৷ নতুন প্রকল্প বন্ধ করতে প্রায়শই বাসিন্দারা আদালতের দ্বারস্থ হন৷
মাটির নীচ দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনও তেমন সমাধান নয়৷ কারণ এতে খরচ পড়ে অনেক বেশি৷ বিদ্যুতের গরম তারের কারণে মাটি শুকিয়ে যেতে পারে যা কৃষির জন্য ক্ষতিকর৷ এতে আশেপাশের কৃষকেরা স্বাধীনভাবে ফসল ফলাতে পারবেন না৷ এজন্য তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বলে জানান ব্রাডকে৷
শুধু একটি দেশেই এমন সমস্যা থেকে গোটা ইউরোপজুড়ে গ্রিড বসানোর জটিলতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে৷ ব্রাডকে বলেন, ‘‘জার্মানির ভেতরে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিবর্তে জার্মানির ভেতর দিয়ে ফ্রান্স থেকে পোল্যান্ডে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ট্রান্সমিশন লাইন তৈরির কথা বলা হলে স্থানীয়দের কাছে এই গ্রহণযোগ্য আরো কমে যেতে পারে৷''
২০৩০ সালের মধ্যে ৮০ হাজার কোটি ইউরো
ইউরোপীয় ইউনিয়নের এনার্জি কমিশনার সিমসন জানান সঞ্চালন লাইনের উপর নির্ভর করবে কোন দেশ বিদ্যুৎ থেকে সবচেয়ে লাভবান হবে৷ এক্ষেত্রে অর্থায়ন বিতর্ক এড়ানোর জন্য অনেকসময় এধরনের প্রকল্পের জন্য ইইউ তহবিল থেকে টাকা ছাড় করা হয়৷ ট্রান্স ইউরোপিয়ান নেটওয়ার্ক ফর এনার্জি বা টেন-ই এর জন্য অর্থায়ন ও কাজের গতি আনতে তাই নির্মাণের বিধি পরিবর্তন করা হয়েছে বলে জানান সিমসন৷
ইউরোপিয়ান রাউন্ড টেবল ফর ইন্ডাস্ট্রি নামের একটি লবি সংস্থার হিসাবে ২০৩০ সালের মধ্যে বৈদ্যুতিক গ্রিড গড়ার জন্য ৮০ হাজার কোটি ইউরো বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে৷ ২০২৩ সালে ইউরোপীয় কমিশন একই পরিকল্পনার জন্য ৬০ হাজার কোটি ইউরোর একটি হিসাব করেছিল৷
এই টাকার অঙ্ক অনেক বেশি হলেও বিদ্যুৎ সরবরাহের দামের হিসাবে তাকে বাস্তবিক বলেই মনে করছেন সিমসন৷ তিনি বলেন, ‘‘মনে রাখতে হবে শুধু ২০২২ সালে ইউরোপীয় ভোক্তারা তৃতীয় দেশ থেকে জীবাষ্ম জ্বালানি কিনতেই ৬০ হাজার কোটি ইউরো খরচ করেছেন৷ কাজেই এই অর্থ অনেক বেশি মনে হলেও জীবাষ্ম জ্বালানিও আসলে বিনা টাকায় আসছে না৷''
তিনি জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৈদ্যুতিক গ্রিডের জন্য অর্থায়ন করা হয় কানেক্টিং ইউরোপ ফ্যাসিলিটি নামের একটি তহবিলের মাধ্যমে৷ পরবর্তী বাজেট বৈঠকে এই তহবিলের আকার বাড়াতে জোর দিয়ে সুপারিশ করবেন বলে জানান সিমসন৷ অন্যদিকে ব্রাডকে মনে করেন, এই অর্থের কিছুটা বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমেও যোগান দেয়া যেতে পারে৷
আন্দ্রিয়াস বেকার/এফএস