উত্তরণের সঙ্গী যখন পুতুলনাচ
৫ জানুয়ারি ২০১৮রূপালি পর্দায় চরিত্রদের অটিজমে আক্রান্ত দেখি আমরা৷ তা দেখে বুকে মোচড় লাগে৷ কিন্তু তারা বাস্তবের মাটিতে নেমে এলে সেটাই আবার অপছন্দের হয়ে দাঁড়ায়৷ ‘কোই মিল গ্যায়া'র রোহিতরূপী হৃতিক রোশন, ‘মাই নেম ইজ খান' ছবিতে শাহরুখ খানের চরিত্র বা ‘বরফি' সিনেমায় ঝিমলিরূপী প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সমস্যা দর্শক কতটা বুঝেছেন! বাস্তবটা কিন্তু তার চেয়েও ঢের বেশি শক্ত৷
চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব নয় বলে বাড়িতে একটু তেরছা নজরে আর পাড়ায় এড়িয়েই চলা হয় শিশু রুবিনা, কৃষ্ণেন্দু, প্রীতমদের৷ এরা কেউ সেরিব্রাল পালসি বা ডিসলেক্সিয়া, তো কেউ ডাউন সিনড্রোম বা অটিজমের শিকার৷ আচরণগত, ভাষাগত, শিক্ষাগত সমস্যার পাশাপাশি এদের মুখোমুখি হতে হয় আরও কঠিন সত্যের— সমাজে ব্রাত্য হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা৷ এত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুরা অবশ্য দিলীপ মণ্ডল বা সৌম্যজিৎ দাসের কাছে ‘তারে জমিন পর' ছবির ঈশান৷ কেন?
ধূমকেতু পাপেট থিয়েটারের কর্ণধার ও পরিচালক দিলীপ মণ্ডল ডয়চে ভেলেকে শোনাচ্ছিলেন তাঁর জার্নির কথা৷ প্রতি মাসের কোনো একটা মঙ্গলবার তাঁরই হাত ধরে কলকাতার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ডে কেয়ারে ভিড় করে রঙচঙে পুতুলের দল৷ তিনি ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালে পুতুল নাচের আসরে রোগাক্রান্ত সেইসব কচি মুখগুলোকে আনন্দ দিতেন৷ তারপর চিকিৎসকদের পরামর্শেই এই পাপেট থেরাপি নিয়ে ভাবলেন৷ বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের কথা ভেবে তিনি পৌঁছে গেলেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির দোরে দোরে৷ পুতুল নাচের আসর, যাকে বিজ্ঞান নাম দিয়েছে পাপেট থেরাপি, তা কতটা সফল? পাপেট শিল্পী দিলীপ মন্ডলের ভাষায়, ‘‘অনেকখানিই সফল৷ বাচ্চারা এখন পুতুলদের দেখে নিজেদের আঙুল নাড়াতে শিখছে, বেশ প্রতিক্রিয়াও দিচ্ছে, এমনকি শারীরিকভাবে নড়াচড়ার দিকে উৎসাহী হচ্ছে৷ অভিভাবকেরা বলছেন, অনেক শিশু ভাবতেও উদ্বুদ্ধ হচ্ছে!''
তিনি জানালেন, স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া থেকেই যারা শত যোজন দূরে, পুতুলদের সঙ্গে কথা বলা বা ভাব বিনিময় করার জন্য তারা যখন উতলা হয়, তখন আনন্দ হয়৷ পরিশ্রম সার্থক মনে হয়৷ পুতুলনাচ ঘিরে তাদের অপরিসীম আগ্রহ এবং প্রতিক্রিয়া নিঃসন্দেহে পাপেট থেরাপির জনপ্রিয়তা প্রমাণ করছে৷
রুবিনা, ঝিলিক, অপর্ণা, শ্রেয়সী এঁদের মনের জগতে কতটা অন্ধকার! কজন খোঁজ রাখেন? এমনকি তাদের মা-বাবাও হয়তো সে খোঁজ পান না৷ অথচ অনায়াসে সে খোঁজ পায় রঙচঙে পোশাক পরা পুতুলরা৷ তেমনটাই শোনালেন দক্ষিণ কলকাতার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ডে কেয়ার ইনচার্জ সুতপা পাল৷ ২৬ বছর ধরে এই ধরনের শিশুদের দেখাশোনার কাজে জড়িত সুতপা শোনালেন পাপেট থেরাপিতে শর্মিলার সাড়া দেওয়ার কথা৷
১৬ বছরের শর্মিলা যখন ডে কেয়ারে এসেছিল, তখন তার আচরণে ছিল প্রচণ্ড হিংস্রতা৷ পাপেট থেরাপির মাধ্যমে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শর্মিলার আচরণ আজ অনেক স্বাভাবিক হয়েছে৷ অনেক শান্ত হয়েছে সে৷ পুতুল হয়ে উঠেছে তার মনোজগতের বন্ধু৷ পুতুলের সঙ্গে কথা বলেই হয়েছে তার এমন পরিবর্তন! এখানে শ্রেয়সীর কথাও উল্লেখযোগ্য৷ চুপচাপ, আপনমনে থাকা এই শিশু রঙচঙে পুতুলের নাম রেখেছে ‘খুশি'৷ পুতুলনাচের সময় আনমনা শ্রেয়সীও নাচানাচি, হইহুল্লোড়ে মগ্ন হয়ে যায়৷ শ্রেয়সীর এই বিমূর্ত চিন্তন ও আ্যাক্টিভিটি নিঃসন্দেহে পাপেট থেরাপির বড় সাফল্য!
আমাদের চারপাশের বাচ্চারা ভিডিও গেম, মোবাইলে মনোযোগী৷ কিন্তু আশা নিকেতনের মিমি, দীপক, প্রীতম, রোশনিরা ঠিক তেমনটি নয়৷ ছবি আঁকাতে এদের মনোযোগ দেখার মতো৷ এদের আঁকার শিক্ষক সৌম্যজিৎ দাস জানালেন, এদের নানা খেলার ছলে নানাভাবে বুঝিয়ে আঁকাতে হয়৷ শিশুরা সে সব ছবিতে নিজেদের ইনপুটও দেয়৷ হয়তো তাদের বহির্জগতের সঙ্গে সংযোগের সমস্যা, কেউ শুনতে পায় না, বা কথা বলতে পারে না৷ তাই ছবি আঁকাটাই তাঁদের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়৷
সৌম্যজিৎ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ছবি আঁকার থেকেও পুতুলনাচ শিশুদের বেশি আকর্ষণ করে৷ নাচ, গান, গল্প এবং আঁকা সবকিছুর মিলিত রূপই হলো পুতুল নাচ, পুতুল নাটক৷ এমনিতেই বা্চ্চাদের পুতুল আকর্ষণীয়৷ বিশেষভাবে পারদর্শীদের ক্ষেত্রে তো বটেই৷ শিশুদের বৌদ্ধিক বিকাশে পুতুলের ভূমিকা তাই অপরিসীম৷ আরও এমন ক্লাস হওয়া উচিত৷''
মনোচিকিৎসক ডঃ কামাল হোসেনের মত, ‘‘এসব ক্ষেত্রে শিশুদের সঙ্গে পরিবারকেও এগিয়ে আসতে হবে৷ নিছক সামাজিক প্রতিষ্ঠার কথা মাথায় রেখে অনেক অবস্থাপন্ন বাড়ির বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুটিকে পাঁচজনের সামনে বেরোতে দেওয়া হয় না৷ নামী থেরাপি না, খেয়াল রাখতে হবে, শিশুদের আনন্দ পাওয়ার বিষয়টি৷ মানসিক ও স্নায়বিক সমস্যায় থাকা এই শিশুরা নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে থাকে৷ এখানে পুতুলনাচের আনন্দই শিশুদের দ্রুত শিখতে মোটিভেট করছে৷''
রুবিনা খাতুন সকালে স্কুল থেকে ফিরেই ডে কেয়ারের পুতুল নাচের আসরে বসতে দেরি করে না৷ ল্যাগব্যাগে মাথা, হাত, পা ছুঁড়ে পুতুলরা ছোট্ট রুবিনার মতো আরও যাদের বন্ধু হয়, সেই শর্মিলা সেন, ঝিলিক দাস সবাই নিম্নবিত্ত বাড়ির সন্তান৷ কারও মা রুটি তৈরি করেন, কারও মা গ্লাভস কাটিং করে সংসার চালান, তো কারও বাবা রাজমিস্ত্রি! পয়সা উজাড় করে নামীদামি ক্লিনিকে গিয়ে কাউন্সেলিং বা থেরাপির টাকা জোগানোর সামর্থ্য এঁদের নেই৷ পাপেট থেরাপিই এই অভিভাবকদের ভরসা৷
দিলীপ মণ্ডল জানালেন দিল্লি এবং মুম্বইয়ে এমন পাপেট থেরাপি যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে৷ তবে পশ্চিমবঙ্গে অনেক পুতুলনাচের দল থাকলেও কেউ সেভাবে এমন কাজে নিয়মিত এগিয়ে আসছেন না৷
ধূমকেতু পাপেট থিয়েটার পাপেট থেরাপিকে শুধু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায় না৷ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের কথা মাথায় রেখে নিজেদের উদ্যোগে পুতুল তৈরি ও পুতুলনাচ দেখানোর কর্মশালা করছে তারা৷ ভবিষ্যতে যাতে এইসব শিশু পুতুল নাচকে পেশা করে সম্মানের সঙ্গে সমাজে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে, সে জন্য এমন শিশুদের দিয়ে তৈরি করানো হচ্ছে পুতুল৷ সহযোগিতা এবং সংযোগ করার জন্য তাদের সঙ্গে থাকছেন মায়েরা৷ শিশুদের সঙ্গে মায়েদের জড়িয়ে পুতুলরা অদূর ভবি্ষ্যতেই রূপোলি পর্দার ঝিলিক নিয়ে আসবে বাস্তবে, আশা এমনটাই৷