ওয়েব বিনোদনের রাজ্য বিস্তৃত হচ্ছে
৭ আগস্ট ২০২০সিনেমা হল তো পিছিয়ে পড়েছেই। প্রশ্ন উঠেছে বিনোদনে টেলিভিশন কোথায় অবস্থান নেবে?
এর জবাব সহজেই পাওয়া যায় টেলিভিশন গুলোর প্রবণতা দেখে। তারা এখন ইউটিউব ও ফেসবুকের ওপরই জোর দিচ্ছেন বেশি। আগে শুধু ইউটিউব পয়সা দিতো। এখন ফেসবুকও দিতে শুরু করেছে। টেলিভিশনগুলো এই সমান্তরাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করার জন্য আলাদা জনবল নিয়োগ করছে। পত্রিকা আর অনলাইনের নজরও ওইদিকে। আর এফএম রেডিওগুলো তাদের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানগুলোর জন্য ইউটিউব চ্যানেল খুলে বসে আছে। সক্রিয় ফেসবুকে।
‘টিকটকে'র অপু ভাই ভিন্ন ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়ায় টিকটক নিয়ে সমালোচনা চলছে বাংলাদেশে। সেই সমালোচনা আবার কতটুকু যৌক্তিক তা নিয়েও আছে বিতর্ক । কিন্তু সমালোচনার মুখে ছাই দিয়ে কোনো কোনো টিকটক স্টারের মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্র অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিউল আলম ভুঁইয়ার মতে, ‘‘যেকোনো মাধ্যমই খারাপ ভাবে ব্যবহারে সুযোগ আছে। শুধু টিকটক কেন, ইউটিউব , ফেসবুকেরও নেতিবাচক ব্যবহার আছে। তার জন্য তো আর মাধ্যম দায়ী নয়৷’’
বাংলাদেশে সমান্তারাল মিডিয়ায় আলোচিত একটি নাম হিরো আলম। ইউটিউব আর ফেসবুকই তাকে হিরো আলম বানিয়েছে। সে তার নাটক, মিউজিক ভিডিও ফেসবুক আর ইউটিউবকে কেন্দ্র করেই তৈরি করে। চার বছরে হিরো আলম ৫০০ মিউজিক ভিডিও আর ২০০ নাটক বানিয়েছেন। কোনো টিভি চ্যানেল তার এই বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান প্রচার না করলেও তার লাখ লাখ দর্শক। ফেসবুকে হিরো আলমের ফলোয়ার ১৫ লাখ। আর ইউটিউবে পাঁচ লাখ। তিনি সাহসী হিরো আলম নামে সিনেমাও বানিয়েছেন, করোনার কারণে মুক্তি দিতে পারেননি।
তাওহিদ আফ্রিদি ইউউিউবে ফান ভিডিও, নাটক, শর্ট ফিল্ম আপ করেন। তার সাবস্ক্রাইবার ৩৫ লাখ। ৫০ লাখ থেকে এক কোটি ভিউ হয়েছে এরকম ভিডিও আছে তার। ২০১৭ সালে গুগল ট্রেন্ডিংয়ে বাংলাদেশে যাদের খোঁজা হয় তাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। সালমান মুক্তাদির এরকম আরেকজন জনপ্রিয় ইউটিউবার। ৫০ লাখের বেশি ভিউ হয়েছে এরকম তার বেশ কিছু ভিডিও রয়েছে। তার সাবস্ক্রাইবার ১৪ লাখ।
কিন্তু এখন এই সব কিছু ছাড়িয়ে হালে ওয়েব ভিডিও, ওয়েব সিরিজ সবচেয়ে বেশি আলোচনায়। গত দুই ঈদে দেখা গেছে ওয়েবেই বেশি নাটক, মিউজিক ভিডিও ও বিনোদনমূল ভিডিও বেশি হয়েছে। এখন অনেক নাটক আর মিউজিক ভিডিও তৈরিই করা হয় ওয়েবকে টার্গেট করে। কয়েক পর্বের নাটক বা টেলিফিল্ম-এ বিনিয়োগ করা হচ্ছে ইউটিউবে দেয়ার জন্যই। আর এখানে একটি সুবিধা হচ্ছে এর দৈর্ঘ্য নিয়ে ভাবতে হয় না। পাঁচ মিনিটের হতে পারে আবার এত ঘন্টারও হতে পারে। আর যারা এটা দেখতে চান তারা তাদের পছন্দ ও চাহিদামত তা দেখতে পারেন। আর এইসব নাটক ও গানের ফেসবুক ট্রেলারেরও অনেক দর্শক। ফলে এখন নির্মাতারা টেলিভিশনের জন্য তৈরি করলেও তারা চিন্তায় ইউটিউবকেও রাখছেন।
আরেকটি সুবিধা হল এখানো নির্মাণ খরচ কম। আর আয় নির্দিষ্ট নয়। দর্শক যদি নেয় তাহলে অনেক আয় হতে পারে। টেলিভিশনের কাছে একটি নাটক বেঁচলে যা পাওয়া যায় তা দিয়ে অনেক সময়ই নির্মাণ খরচ ওঠে না। ওয়েব সিরিজ, নাটক, ফিল্ম তৈরি করে নির্মাতা শিহাব শাহীন বেশ আলোচনায়। তার মতে," এই করোনার সময় সিনেমা হল বন্ধ, টেলিভিশনগুলোর মন্দা অবস্থা। আমার তো মনে হয় ওয়েবই শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে।”
বাংলাদেশে নাটক, টেলিফিল্ম বা মিউজিক ভিডিওর দ্ইুশ'র মত প্রোডিউসার আছেন। তারা কেউই আর শুধু টেলিভিশনের জন্য নির্মাণ করেন না। একই কাজ তারা ইউডিউবেও দেন। আর দেখা যায় সেখানেই দর্শক বেশি। আর টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও ইউটিউবকেও টার্গেটে রাখে। সবারই ইউটিউব চ্যানেল আছে। মিউজিক ভিডিওর জন্য বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ইউটিউবেই তাদের প্রিমিয়ার করে। কোনো কোনো নির্মাতা আছের শুধু ইউটিউবের জন্যই কাজ করেন।
শিহাব শাহীনের বিরুদ্ধে অশ্লিলতার অভিযোগও করেন কেউ কেউ । এর জবাবে তিনি বলেন," ঈর্ষা থেকে এগুলো করা করা হয়। আমার আগস্ট ফোরটিন মানুষ ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছে। কিন্তু এটার গভীরতা যারা বুঝতে পারেননি তারাই সমালোচনা করেন। আর ওয়েব একটি ভিন্ন প্লাটফর্ম। এখানে স্বাধীনতার জায়গাটি বেশি। এটা বুঝতে হবে।”
হিরো আলমের "ভদ্র” দর্শক নেই। তবে তাই বলে তার নাটক বা মিউজিক ভিডিওর দর্শকের ঘাটতিও নেই। নায়ক ও প্রযোজক অনন্ত জলিল তাকে নিয়ে সিনেমা তৈরিরও চুক্তি করেছিলেন । কিন্তু "ইন্ডাষ্ট্রির” চাপে তিনি শেষ পর্যন্ত সেই চুক্তি বাতিল করেছেন। হিরো আলমের কথা," আমার চেহারা ভালো নয়, কিন্তু আমার সাহস আছে। যে যত সমালোচনাই করুক না কেন আমি তাতে ভয় পাই না। আমার দর্শক তৈরি হয়েছে। তারা আমাকে ভালোবাসে। তারাই ইউটিউব আর ফেসবুকে আমার নাটক আর মিউজিক ভিডিও দেখে। আমার তা থেকে আয় হয়। সেই আয় থেকেই আবার নতুন প্রোডাকশন নামাই।” ৫০ লাখ ভিউ হয়েছে এমন অনেক প্রোডকশন আছে হিরো আলমের। আর এই বৃহস্পতিবারে দেখা যায় তার একটি ফেসবুক ভিডিও পাঁচ ঘন্টায় ৩০ লাখ ভিউ হয়েছে।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন বিনোদনের মাধ্যমের একটা পরিবর্তন আসছে। এখন ইন্টারনেটের যুগ হওয়ায় মাল্টি মিডিয়া প্লাটফর্মের গুরুত্ব বাড়ছে। তাই ইউটিউব, ফেসবুক ভিত্তিক বিনোদনের দিকে মানুষ ঝুকছে। এটার একটা সুবিধা হলো যে কেউ তার কনটেন্ট দিতে পারেন। যারটা ভালো লাগবে মানুষ তারটা দেখবে। আর এখানে ছোট একটা ভিডিও কনটেন্ট পপুলার হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিউল আলম ভুঁইয়া বলেন," এখন তো সিনেমারও ডিজিটাল ডিস্ট্রিবিউশন হচ্ছে। ভবিষ্যকে এটা আরো বাড়বে। এক সময় টেলিভিশন আর অনলাইন বিনোদন বলে আলাদা কিছু হয়তো থাকবেনা। সব একাকার হয়ে যাবে।”