ঢাকা : যে শহরের রাজপথে, অলিগলিতে সহস্র অপরাধ
১১ নভেম্বর ২০২২পুলিশের নথি বলছে, ঢাকা শহরের কিছু এলাকা কম অপরাধপ্রবণ, কিছু এলাকা বেশি অপরাধপ্রবণ৷ অপরাধীদের সংখ্যা নির্ণয়ের চেষ্টাও করে পুলিশ৷ অপরাধীদের প্রেফাইলও রাখা হয়৷ সেখানে দেখা যায় কোনো কোনো অপরাধী একের পর এক অপরাধ করছে, গ্রেপ্তার হচ্ছে এবং তারপর জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার একই অপরাধে জড়াচ্ছে৷
পুলিশের কাছে আপরাধের যে হিসাব পাওয়া যায় তা মূলত প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে তৈরি৷ তবে পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়ে সন্দেহজনকভাবে কাউকে গ্রেপ্তার করলে সেই তথ্যও থাকে হিসেবে৷
‘বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলির শহর’ ঢাকায় মহানগর পুলিশ গত ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ৪৫ হাজার ৫৫৭ জনকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার করেছে৷ গড়ে প্রতি মাসে গ্রেপ্তার হয়েছেন পাঁচ হাজারের বেশি৷এই সময়ে মামলা হয়েছে ২২ হাজার ২৮৭টি৷ গড়ে প্রতি মাসে মামলা হয় আড়াই হজারের মতো৷
অপরাধ ও মামলার রকমফের
অপরাধের তালিকায় হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, প্রতারণা- বলতে গেলে সব আছে৷ পুলিশ তাদের নিয়ম অনুযায়ী অপরাধের যে ধরন নির্ধারণ করে, তার মধ্যে আছে ডাকাতি, খুনসহ ডাকাতি, দস্যুতা, খুন, দাঙ্গা, আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার আইন), নারী ও শিশু নির্যাতন, অপহরণ, চুরি, ছিনতাই, অস্ত্র, মাদক, প্রতারণা, জালিয়াতি, দুদক, বিশেষ ক্ষমতা আইন, পুলিশের ওপর হামলা, দাঙ্গা, অপহরণ, চাঁদা, মুক্তিপণ, পাচার প্রভৃতি৷ এসব অপরাধের আবার নানা উপ-বিভাগ আছে৷
সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ ও নারী ও শিশু নির্যাতন
পুলিশের হিসেবে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি যে অপরাধ হয় তা হলো ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতন৷ ৯ মাসে এ অপরাধের মামলা হয়েছে এক হাজার ৫০৭টি৷ এরপর চুরি- এক হাজার ২৫৫টি৷ এর বাইরে পুলিশ উদ্ধার অভিযানের পর যে মামলা করে তাতে শীর্ষে আছে মাদকদ্রব্য৷ এই সময়ে পুলিশ মাদকের মোট মামলা করেছে ১২ হাজার ৫০৩টি৷ প্রতি মাসে গড়ে এক হাজার ৩৮৯টি মাদকের মামলা করে পুলিশ৷ ৯ মাসে ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে মাত্র ৭২টি!
‘চোরের রাজা’ সিধেল চোর
ঢাকায় অনেক দালান-কোঠা থাকলেও চুরির মধ্যে সিধেল চুরিই বেশি৷ সিধেল চুরি হলো শাবল দিয়ে সিঁদ কেটে চুরি৷ ওই ৯ মাসে এই ধরনের চুরি হয়েছে ৫৬১টি৷ এছাড়া আছে গ্রিল কেটে চুরি, তালা ভেঙে চুরি, গাড়ি চুরি, তার চুরিসহ আরো অনেক ধরনের চুরি৷ রাজধানী শহরে গরু চুরির ঘটনাও ঘটেছে চারটি৷
কম ও বেশি অপরাধের এলাকা
সবচেয়ে বেশি চুরি হয় তেজগাঁ এলাকায়৷ তারপরে রয়েছে রমনা ও মিরপুর৷ সবচেয়ে কম চুরি হয় লালবাগ এলাকায়৷ উত্তরা এবং গুলশানেও চোরদের উৎপাত কম নয়৷ ছিনতাইয়েও সবচেয়ে এগিয়ে আছে আছে তেজগাঁ এলাকা৷ তারপরে উত্তরা, মিরপুর ও ওয়ারির অবস্থান৷ ৯ মাসে ঢাকায় ১৩৪টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ বেশি খুন হয়েছে ওয়ারিতে ৩০টি৷ তারপরে মিরপুরে- ২৬টি৷ সবচেয়ে বেশি ডাকাতি হয় মিরপুর এবং ওয়ারিতে৷অন্যদিকে এই সময়ে সবচেয়ে কম ডাকাতি হয়েছে গুলশানে৷
মাদকদ্রব্যে এগিয়ে লালবাগ, মতিঝিল ও মিরপুর৷ তবে ঢাকার সব এলাকায়ই মাদকের ভয়ংকর থাবা দেখা যায়৷ ৯ মাসে সর্বনিম্ন মাদকসংক্রান্ত মামলা হয়েছে রমনা এলাকায়- ৮৪৪টি৷
ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ওয়ারি ও মতিঝিলে৷
এক বছর আগে যেমন ছিল ঢাকা
২০২১ সালের ১২ মাসে ঢাকায় বিভিন্ন অপরাধে মামলা হয়েছে ২৭ হাজার ৪৬১টি৷ মাদক দ্রব্যের মামলাই ছিল শীর্ষে- ১৬ হাজার ২১৬টি৷ তারপরে ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা- দুই হাজার ২১৮টি৷ তৃতীয় অবস্থানে ছিল চুরি- এক হাজার ৩৪৩টি৷ সেই একবছরে ঢাকায় গরু চুরিও হয়েছে চারটি৷
পুলিশের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে ঢাকায় হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ১৬৬টি, অপহরণ ৪৯টি এবং ডাকাতি ১৬৬টি৷
তৈরি হচ্ছে অপরাধীদের ডাটাবেজ
ঢাকায় বিভিন্ন অপরাধে জড়িতদের ডাটাবেজ তৈরি হচ্ছে৷ আটকের সময়ের তথ্যের ভিত্তিতে এই ডাটাবেজ তৈরির কাজ চলছে৷ তবে এখন পর্যন্ত চোর আর ছিনতাইকারীর ডাটাবেজ তৈরিতেই জোর দেয়া হয়েছে ৷ ঢাকার ৫০টি থানা এলাকায় ৫৪৪ জায়গা চিহ্নিত হয়েছে৷ ওইসব জায়গায় ছিনতাইকারীরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয়৷ পাঁচশ'র মতো ছিনতাইকারীর ডাটাবেজ তৈরি হয়েছে৷ তবে তাদের সংখ্যা আরো বেশি বলে জানায় পুলিশ৷ তাই ডাটাবেজে তাদের সংখ্যা বাড়বে৷ অন্যদিকে চার হাজার চোরের একটি ডাটাবেজ তৈরির কাজ চলছে৷ ওই ডাটাবেজে চোরদের নাম-পরিচয় ছাড়াও কোন চোর কোন ধরনের চুরিতে দক্ষ, কতগুলি চুরি করেছে, কতবার গ্রেপ্তার হয়ে ছাড়া পেয়েছে- তা-ও থাকছে৷
ঝোঁক বাড়ছে চুরিতে
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের উপ পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, ‘‘ঢাকায় ছিনতাই ও ডাকাতিসহ কিছু অপরাধ কমেছে৷ কিন্তু চুরি বাড়ছে৷ এর কারণ ছিনতাই ও ডাকাতিকে অনেক বেশি ঝুঁকি নিতে হয়৷ ধরা পড়লে শাস্তি বেশি৷ কিন্তু প্রাপ্তি সব সময় ভালো হয় না৷ তাই ওই অপরাধীরা চুরিতে ঝুঁকছে৷ আগে আন্তঃজেলা ডাকাত ছিল এখন আন্তঃজেলা চোর হয়েছে, এমনকি ঢাকায় আগে একেক এলাকায় একেক গ্রুপ চুরি করত, এখন চোররা পুরো ঢাকা শহরেই চুরি করে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘এই চোররা এখন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে৷ তারা ঢাকার বাইরে থেকে এসে রেকি করে যায়, পরে আবার এসে চুরি করে৷ তারা ভুয়া ন্যাশনাল আইডি কার্ড দিয়ে সিম নিয়ে তা ব্যবহার করে৷’’ এমন জালিয়াতির প্রয়োগ ডাকাতি ও ছিনতাইসহ অন্য অপরাধের ক্ষেত্রেও হচ্ছে বলে জানান তিনি৷
‘ঢাকার মানুষ নির্লিপ্ত’
প্রতারণা ও ডিজিটাল অপরাধ বেড়েছে বলেও জানান উপ পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান৷ নারী নির্যাতন, বিশেষ করে ধর্ষণের পিছনেও আছে ডিজিটাল প্রযুক্তি৷
তিনি বলেন, ‘‘আমরা ডাটাবেজ তৈরি করছি, তাদের ওপর নজরদারিও বাড়িয়েছি৷ চক্রগুলোর সদস্যদের গ্রেপ্তার করছি৷ কিন্তু ঢাকা শহরে মানুষ যেন নির্লিপ্ত৷ একজনের সামনে দিয়ে পাশের বাড়ির কিছু কেউ চুরি করে নিয়ে গেলে তিনি কিছু বলেন না৷ আমাদের আরো সামাজিক হতে হবে আর হতে হবে সচেতন৷’’
অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধিতে সামাজিক বৈষম্যের প্রভাব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘‘দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আশা করা হয়েছিল ছিনতাই, চুরির মতো অপরাধ কমে যাবে৷ কিন্তু এখন শুধু ঢাকা শহর নয়, সারাদেশেই এটা বেড়ে যাচ্ছে৷ করোনার অভিঘাত ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে যারা পেশাদার নয়, তারাও এই ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে৷ আর আধুনিকতার অপব্যপব্যবহারে ধর্ষণও উদ্বেগজনকহারে বেড়ে গেছে৷ বেড়েছে কিশোর অপরাধ, মাদক৷’’
তার মতে, ‘‘অপরাধের একটি ঐতিহাসিক ধারা আছে, তার সঙ্গে আবার এখনকার প্রযুক্তি যুক্ত হয়ে অপরাধের নতুন ধারা যুক্ত হয়েছে৷ ঢাকা একটা মেগাসিটি, সে কারণে সব ধরনের অপরাধের প্রবণতা এখানে থাকে৷ আর এই শহরে আছে ব্যাপক আর্থিক এবং সামাজিক বৈষম্য, যা হতাশার সৃষ্টি করে এবং অপরাধ বাড়িয়ে দেয়৷’’
তার কথা, ‘‘আমাদের যে পুলিশ, তারা এই নানা ধরনের অপরাধ দমনে পুরোপুরি দক্ষ নয়৷ তাদের দক্ষতা এবং আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞান আরো বাড়াতে হবে৷’’
‘‘এখানে কিন্তু হোয়াইট কলার ক্রাইম অব্যাহত আছে৷ আরো বাড়বে৷ ঘুস, দুর্নীতি, ব্যাংকের টাকা লুটপাট, অর্থ পাচার বন্ধ হচ্ছে না৷ এটাও প্রভাব ফেলে৷ যাদের নেই, তারাও অপরাধে জড়িয়ে পড়ে,’’ অভিমত এই অপরাধ বিজ্ঞানীর৷