1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নতুন বছরে কলকাতার সাইনবোর্ড বাংলায়

২৮ ডিসেম্বর ২০২৪

কলকাতার দোকান, রেস্তোরাঁ, বাণিজ্যিক কেন্দ্র, সরকারি দপ্তরের সাইনবোর্ড থেকে বিজ্ঞাপনী হোর্ডিংয়- সবখানে বাধ্যতামূলকভাবে বাংলায় নাম লিখতে হবে৷

https://p.dw.com/p/4oeEC
কলকাতা
কলকাতার এমন বহু এলাকা বা রাস্তাঘাট রয়েছে যেখানে বাংলা লিপির দেখা মেলে না বললেই চলেছবি: Payel Samanta/DW

এমনই এক নির্দেশনা জারি করেছে কলকাতা পুরসভা৷ প্রশ্ন হলো, এমন নির্দেশনা কি কার্যকর করা সম্ভব হবে?

প্রাচীন সময় থেকেই কসমোপলিটন শহর কলকাতায় নানা জাতি, ধর্ম ও ভাষাভাষী মানুষের বাস৷ কিন্তু শহরের পথঘাটের ফলকে বা দোকানের সাইনবোর্ডে ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলা ভাষা৷

বঙ্গে ব্রাত্য বাংলা

কলকাতার এমন বহু এলাকা বা রাস্তাঘাট রয়েছে যেখানে বাংলা লিপির দেখা মেলে না বললেই চলে৷ এমন পরিস্থিতিতে নতুন বছর থেকে কলকাতার ১৪৪টি ওয়ার্ডের সমস্ত দোকানের সাইনবোর্ড বাংলায় লেখা আবশ্যিক করা হচ্ছে৷

তবে শুধু বাংলাতেই লিখতে হবে সাইনবোর্ড এমনটা নয়৷ পাশাপাশি অন্য ভাষায় সাইনবোর্ড লেখার ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকবে না বলে মেয়র ফিরহাদ হাকিম জানিয়েছেন৷

বাংলা ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পেয়েছে৷ অথচ বাঙালির শহর কলকাতায় বাংলায় সাইনবোর্ড, হোর্ডিং সর্বত্র নেই৷ এই সমস্যা চিহ্নিত করে গত অক্টোবরে তৃণমূল কাউন্সিলর বিশ্বরূপ দে কলকাতায় পুরসভার একটি বৈঠকে জানিয়েছিলেন, সরকারি ও বেসরকারি অফিসের সমস্ত সাইনবোর্ডে অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষার উপস্থিতি থাকা উচিত৷

বাংলা ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পাওয়ার পর মেয়র বলেছিলেন, ‘‘আগে বড় করে বাংলায় সাইনবোর্ড লিখুন৷ তারপর যে ভাষা পছন্দ, সেটা হিন্দি, উর্দু, কিংবা ইংরেজি হোক, সেই ভাষায় লিখতে পারেন৷ বাংলা ভাষাকে আগে গুরুত্ব দিন৷ রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষ বাংলা বোঝেন৷ মাতৃভাষা বাংলা৷ তাই বাংলায় লিখলে সকলের বুঝতে সুবিধা হবে৷ সকলে গর্ব অনুভব করতে পারবেন৷''

এবার পুরসভার পক্ষ থেকে নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে৷ ২০২৫-এর ২১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এই কাজ শুরু করতে হবে বলে পুরসভার তরফ থেকে জানানো হয়েছে৷ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের পক্ষ থেকে ১৪৪টি ওয়ার্ডের সব দোকানের তালিকা তৈরির কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে বলে সূত্রের খবর৷ দোকানের মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে৷

এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে বাংলা পক্ষ সংগঠনের নেতা গর্গ চট্টোপাধ্যায় ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘বাংলা পক্ষের খুব স্পষ্ট দাবি, সাইনবোর্ডের সবচেয়ে বড় লেখাটাই বাংলায় থাকতে হবে৷ নিয়মরক্ষা করার জন্য এক কোণে ছোট করে বাংলা লিখে দিলে হবে না৷ একজন বাঙালি, বাংলার মাটিতে যেন কোনো একটা জায়গায় সাইনবোর্ড দেখে বুঝতে পারেন যে, তিনি তার নিজের মাটিতেই রয়েছেন৷’’

সাইনবোর্ডের সবচেয়ে বড় লেখাটা বাংলায় থাকতে হবে: গর্গ চট্টোপাধ্যায়

ফের পুরোনো দাবি

বাম সরকারের আমলেও বাংলায় সাইনবোর্ড লেখার নিয়ম জারি হয়েছিল৷ এই চেষ্টা নতুন কিছু নয়৷ শুধু সরকারি নয় নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে এই দাবি আগে উঠেছে৷ কলকাতার একটা বড় অংশের জনসমষ্টি অবাঙালি৷ এদের একাংশ আবার সংখ্যালঘু, উর্দুভাষী৷ অবাঙালি অধ্যুষিত কলকাতার কোনো কোনো জায়গায় ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু দেখা গেলেও বাংলার চিহ্ন মেলে না৷

পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে দাঁড়িয়ে, কলকাতার অনেক রাস্তায় হাঁটলে মনে হতেই পারে, এটা কি আদৌ বাংলা ভাষাভাষী প্রধান রাজ্য! এই ছবিটা বদলের উদ্যোগে সামিল হয়েছিলেন বিদ্বজ্জনেরাও৷ আড়াই দশক আগে এই আন্দোলন হয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো কবি ও সাহিত্যিকদের উদ্যোগে৷

সুনীলের মতো তারকা কথাশিল্পী কলকাতার দোকানে দোকানে ঘুরেছিলেন৷ বিপণীর কর্ণধারদের সঙ্গে কথা বলে বুঝিয়েছিলেন, কেন তাদের সাইনবোর্ডে বাংলা রাখতে হবে৷ শুধু সাইনবোর্ড নয়, বৃহত্তর ক্ষেত্রে সরকারি কাজকর্মে, অফিস ও আদালতে বাংলার ব্যাপক প্রয়োগের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন তারা৷

তারপরে আবার তৃণমূল আমলে এখন এই নিয়ম জারির কথা ভাবতে হচ্ছে৷ কলকাতার সাবেক মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘মেয়র থাকাকালীন নির্দেশ জারি করেছিলাম যে, কলকাতা শহরের বুকে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন, তারা তাদের হোর্ডিং বা সাইনবোর্ড যে কোনো ভাষায় লিখুন না কেন, কিন্তু বাংলায় লিখতে হবে৷ সেটা কার্যকর হয়েছিল৷ লাইসেন্স নবায়নের এর প্রাথমিক শর্তই ছিল তা-ই৷''

তিনি বলেন, ‘‘তার আগে কলকাতায় হাঁটলে মনে হত না যে কলকাতায় আছি৷ পরবর্তীতে তৃণমূল আমলে দেখা গেল কলকাতার বহু সাইনবোর্ড ধীরে ধীরে বাংলা তুলে দিয়েছে৷ পুরসভার দিক থেকে অনীহা ছিল এই নিয়ম কার্যকর করানোর ক্ষেত্রে৷’’

তবে শুধু খাতা-কলমে নিয়ম করলে চলবে না, সেই নিয়ম কার্যকর করার প্রচেষ্টাও রাখতে হবে বলে অনেকে মনে করেন৷

গর্গ বলেন, ‘‘লোক দেখানোর নিয়ম বানিয়ে রাখলে সমস্যার মূল সমাধান হবে না৷ বাংলায় সাইনবোর্ড না লিখলে ট্রেড লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে৷ এই নিয়মটি নিশ্চয়ই মানা হচ্ছিল না৷ যে কারণে নতুন করে নির্দেশিকা জারি করতে হল৷ বাংলা পক্ষের স্পষ্ট প্রশ্ন, আগের নিয়মটি যারা মানেননি, তাদের ট্রেড লাইসেন্স কি বাতিল হয়েছে? নতুন নির্দেশিকা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে, সেটা উহ্য থেকে গিয়েছে৷’’

ভাষার বৈচিত্র্য ও পরমতসহিষ্ণু হতে শেখায় যে ‘বাংলা স্কুল’

বাংলার মাটিতে বাংলা ভাষায় সাইনবোর্ড না লেখার পিছনে কী কারণ? গর্গ বলেন, ‘‘বাংলার মাটিতে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি বহিরাগতদের দখলে চলে যাওয়া এবং সেখান থেকে বলপূর্বক বাঙালিকে বিতাড়িত করা এবং বিভিন্ন এলাকায় জনবিন্যাস বদলে যাওয়া মূলত এর কারণ৷ সেজন্যই শহরাঞ্চল এবং শিল্পাঞ্চলগুলিতে বাঙালি সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার যে ভয়ংকর রোগ তৈরি হয়েছে, এটা তার উপসর্গ মাত্র৷’’

শুধু কলকাতা নয়, ভারতের অন্যান্য জায়গাতেও স্থানীয় ভাষা অনেক গুরুত্ব পায়৷ মহারাষ্ট্রে দোকান এবং সরকারি-বেসরকারি অফিস-কাছারিতে সাইনবোর্ড মারাঠিতে লেখাবাধ্যতামূলক করা হয়েছে৷ মুম্বাই পুর এলাকার (বিএমসি) সংশোধিত বিধিতে বলা হয়েছে, শহরের সমস্ত সাইনবোর্ডে মারাঠিতে প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা লেখা বাধ্যতামূলক৷ অন্য ভাষা থাকতে পারে৷ তবে সেগুলির তুলনায় মারাঠিতে অনেক বড় হরফে লেখা থাকতে হবে৷

সাহিত্যিক জয়ন্ত দে ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘যেকোন প্রদেশে তার নিজস্ব ভাষার গুরুত্ব থাকা উচিত৷ আমাদের এখানে যদি এই গুরুত্ব না থাকে, তাহলে আমাদেরই কোথাও বাংলা ভাষা নিয়ে একটা হীনম্মন্যতা তৈরি হচ্ছে যেন মনে হয়৷ কলকাতা পুরসভার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছি৷’’

বিকাশরঞ্জন বলেন, ‘‘দোকানে সাইনবোর্ড আঞ্চলিক ভাষায় দেওয়াটা প্রতীকী মাত্র৷ আসলে ব্যবসাটা হচ্ছে এমন একটা শহরে, সেই শহরের মানুষ যাতে লেখাটা বুঝতে পারে৷ অন্যান্য শহরে গেলে আপনি দেখবেন সর্বত্রই স্থানীয় ভাষার গুরুত্ব পায়৷ এখানেও সেটাকে গুরুত্ব দিতে হবে৷’’

গর্গ বলেন, ‘‘বেঙ্গালুরু এবং মুম্বই পুরসভায় সাইনবোর্ড নিজের আঞ্চলিক ভাষায় না লেখা হলে পুরসভা থেকে সাইনবোর্ড ভেঙে দেওয়ার অভিযান হয়েছে৷ কলকাতা পুরসভার এরকম অভিযান আমরা কখনো দেখিনি৷ কলকাতা শুধু নয়, বাংলার সর্বত্র এই নিয়ম চালু করা হোক৷ নিয়ম না মানলে জরিমানার ব্যবস্থা হোক৷’’

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য