নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন মত
২২ ডিসেম্বর ২০২৪দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক এমন দাবি জানিয়েছে বিএনপি৷ জামায়েতে ইসলামী চাইছে, ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন আয়োজন করুক সরকার৷ তবে গণঅধিকার পরিষদ এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি বলছে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ শেষে নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে৷
গত ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে অনুষ্ঠিত হতে পারে সে বিষয়ে ধারণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস৷ ভাষণে তিনি বলেন, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়৷ এরপর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘‘আশা করতে পারেন যে নির্বাচন হচ্ছে ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে৷’’
দ্রুত নির্বাচন দাবি বিএনপির, ২০২৫ সালের মধ্যে চায় জামায়াত
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বিএনপি বলছে, নির্বাচনের জন্য এতো লম্বা সময়ের প্রয়োজন নেই৷ দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের বক্তব্যের পর হতাশা প্রকাশ করে সংবাদ মাধ্যমকে জানান, তারা চেয়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করবে৷
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সভা শেষে তিনি বলেন, ‘‘স্থায়ী কমিটি মনে করে যেহেতু নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়ে গেছে, সেহেতু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিলম্বের প্রয়োজন নেই৷ নির্বাচন কেন্দ্রিক সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব৷ জনগণ এই বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছ হতে সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রত্যাশা করে৷’’
একই কথা বলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হারুনুর রশীদ৷ সরকারের কাছ থেকে দ্রুত নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ প্রত্যাশা করেন৷ বিএনপির এই রাজনীতিবিদের মতে, নির্বাচন দেরি হলে বাড়বে সামাজিক অস্থিরতা৷ সুষ্ঠু নির্বাচনই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে বলে মনে করেন তিনি৷
নির্বাচন ও সংস্কার প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেক হারুনুর রশীদ বলেন, ‘‘আমরা সরকারকে সহযোগিতা করছি, করে যেতে চাই৷ এখন সংস্কার আর বিচারের কথা বলে নির্বাচন ঝুলিয়ে দেওয়ার কোন সুযোগ নেই৷ দেশের মানুষ এগুলো বোঝে৷ আমরা বলছি, সংস্কারও চলছে, বিচারও চলবে৷’’
তবে এখনই এই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কথা বিএনপি ভাবছে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সরকারও নিশ্চয় বিষয়টি বুঝবে৷’’
এদিকে, গতকাল শনিবার সমমনা ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট এবং লেবার পার্টির সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি৷
বৈঠকের আলোচনা প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, ‘‘বিএনপি, ১২ দলীয় জোটসহ যারা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে, আমাদের সেই আন্দোলন এবং সেই ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায় নাই৷ আগামীতে সেটা আরও গভীরভাবে অনুভূত হবে৷ বিএনপি অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে খুব শিগগিরই কর্মসূচি ঘোষণা করবে৷ বর্তমানে দেশের উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমাদের আগামী দিনে কর্মসূচি কি হওয়া উচিত, সেসব বিষয় নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছি৷’’
বৈঠক শেষে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘‘আমরা চাই, সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে হবে৷ সংস্কারের নামে নির্বাচনে দেরি করা ঠিক হবে না৷ আমরা দীর্ঘ ১৫ বছর আন্দোলন করেছি এ দেশের মানুষের ভোটের অধিকারের জন্য, ভাতের অধিকারের জন্য, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য৷ বাংলাদেশে সব সমস্যার সমাধান হবে যদি জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়৷’’
এদিকে ২০২৫ সালের মধ্যেই নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী৷ অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নিয়ে দলের নেতার কোনো কথা না বললেও শনিবার কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে এ. জে মডেল হাই স্কুল মাঠে শনিবার জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত যুব সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘‘২০২৫ সালের ভেতরেই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে হবে৷ তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে আগামী বছরের শেষের দিকে নির্বাচনের আয়োজন করা হবে, এটাই আমাদের দাবি৷’’
‘২০২৫ সালে নির্বাচন হয়ে যাওয়া ভাল’
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) এবং নাগরিক ঐক্য ২০২৫ সালে নির্বাচন হতেই হবে এমন দাবি না করলেও দল দুটি মনে করে ২০২৫ সালের মধ্যেই নির্বাচন হয়ে যাওয়া ভাল৷
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে ২০২৫ সালের মধ্যেই ভোটের ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘তিনি (প্রধার উপদেষ্টা) বলেছেন, ঐক্যমতের ভিত্তিতে যদি আরও কিছু সংস্কার প্রয়োজন হয় তাহলে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে ভোটগ্রহণ সম্ভব হতে পারে৷ এখন আমরা যদি সবাই মিলে চাই, ২০২৫ সালের মধ্যেই ভোট দিয়ে দিতে হবে, তাহলে তিনি সেটাই দেবেন৷ আমরা মনে করি, সংবিধান সংস্কারের মতো বিষয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত৷ আমাদের দল থেকে আমরা যেটা বলেছি, আমরাও চাচ্ছি ২০২৫ সালের মধ্যে ভোট হয়ে যাওয়া ভালো হবে৷’’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাও মনে করেন, ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন আযোজন সম্ভব৷ নির্বাচন বিষয়ে নিজেদের অবস্থান জানাতে গিয়ে ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমরাও মনে করি, ২০২৫ সালের মধ্যেই ভোটের আয়োজন হলে সবার জন্য ভালো হবে৷’’
‘ফ্যাসিস্টের বিচারের আগে দেশে নির্বাচন নয়’
এদিকে, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের মতে নির্বাচনের জন্য সরকারকে চাপ প্রয়োগ করা ঠিক হবে না৷ তার মতে, দেশে যেন আবার ‘ফ্যাসিস্টি ব্যবস্থা' ফিরে আসতে না পারে সেই কাঠামো তৈরি করতে হবে৷ এরমাধ্যমেই জুলাই-আগস্টের আকাঙ্খা পূরণ হবে বলে মনে করেন তিনি৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘শুধু একটা নির্বাচন দিলেই তো এবারের অভ্যুত্থানের আকাঙ্খা পূরণ হবে না৷ যারা গণহত্যা চালিয়েছে, তাদের বিচার হতে হবে৷ তা না করে যদি শুধু একটা ভোট দেওয়া হয় তাহলে তো আবারও সেই ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা ফিরে আসতে পারে৷’’
‘সবাই সরকারকে ওন করছে' এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানও তো এই সরকারের প্রতি সমর্থন দেখিয়েছেন৷ সরকারকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া আমাদের সকলের কর্তব্য বলে আমি মনে করি৷’’
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, ‘‘ফ্যাসিস্ট ও তাদের দোসরদের বিচারের আগে দেশে কোনও নির্বাচন হবে না৷ আমরা একটি রাজনৈতিক উদ্যোগ, যে উদ্যোগগুলো ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে অনেকগুলো শক্তি মাঠে এসেছিল, যারা আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করেছিল এবং যারা বাংলাদেশকে নতুনভাবে সাজাতে চায়৷ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি থেকে মুক্ত করে বাংলাদেশকে একটি সুন্দর জায়গায় নিয়ে যেতে চায়৷ আগামীর বাংলাদেশকে সুন্দরভাবে স্বপ্নভূমি দক্ষিণ এশিয়া এবং বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপন করতে চায়৷’’