পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ছবি হল পায় না, বারবার এই বিতর্ক কেন?
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪দেশজুড়ে বক্স অফিসে সাড়া জাগিয়েছে দক্ষিণের ছবি 'পুষ্পা টু'। এই ছবির হিন্দি ভার্সন রাজ্যের শহর থেকে জেলার বিভিন্ন হলে চলছে। সিঙ্গল স্ক্রিন থেকে মাল্টিপ্লেক্স, সর্বত্রই শো হাউসফুল। এর মধ্যে বাংলা ছবির মুক্তির দিন এগিয়ে আসায় তৈরি হয়েছে বিতর্ক।
বাংলা ছবির মুক্তি
সামনেই বড়দিন ও নতুন বছর। এই উপলক্ষে অন্তত চারটি ছবি মুক্তি পাওয়ার কথা। দীপক অধিকারী ওরফে দেবের 'খাদান', রাজ চক্রবর্তীর 'সন্তান', প্রতীম ডি গুপ্তর 'চালচিত্র' ও মানসী সিংহের '৫ নং স্বপ্নময় লেন'। এই চারটি ছবিকে জায়গা করে দিতে হবে বিভিন্ন হলে।কিন্তু মুক্তির দিন এগিয়ে এলেও বুকিং পাওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পিছিয়ে পড়েছে চারটি বাংলা ছবি।
এই ছবিগুলির মধ্যে 'সন্তান' ও 'খাদান' এর নেপথ্যে রয়েছে বড় প্রযোজনা সংস্থা। 'সন্তানের' ক্ষেত্রে এসভিএফ এবং 'খাদানের' ক্ষেত্রে সুরিন্দর ফিল্মস ও দেব। এই দুটি ছবিও হলে জায়গা পেতে বেগ পাচ্ছে। সেই কারণে ক্ষোভ গোপন রাখেননি দেব ও রাজ চক্রবর্তী ।
ফেসবুক পোস্টে দেব লিখেছেন, "খাদানের বুকিং শুরু হয়নি বলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করছি। এর জন্য দায়ী ভিন্ন ভাষার ছবি।" রাজ চক্রবর্তীর বক্তব্য, "আমাদের রাজ্যে বাংলার আগে হিন্দিকে প্রাধান্য দেয়া হয়। আমি শুধু সন্তানের কথা বলছি না। সব বাংলা ছবিকেই সমান গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কিন্তু সেটা করা হয় না।"
মুক্তি পেতে চলা বাকি দুটি বাংলা ছবি কম বাজেটের। ফলে '৫ নং স্বপ্নময় লেন' এবং 'চালচিত্র' আরো সমস্যার মধ্যে রয়েছে। রাজ্যের শাসক দলের দুই জনপ্রতিনিধি হয়েও দেব ও রাজের খেদ প্রমাণ করে দিচ্ছে যে, ছোটখাট প্রযোজনা সংস্থার ছবির হল পাওয়া কতটা কঠিন। এমনকী 'সন্তান' ছবিটিও মাল্টিপ্লেক্স বুকিং পেলেও কোন সিঙ্গল স্ক্রিন এখনো পায়নি।
দক্ষিণী ছবির দাপট
এই অভিজ্ঞতা নতুন কিছু নয়। অতীতেও দেখা গিয়েছে, হিন্দি ছবির জন্য বাংলা সিনেমা জায়গা পাচ্ছে না। এর পিছনে রয়েছে বিশুদ্ধ ব্যবসায়িক কারণ। মাল্টিপ্লেক্স ও সিঙ্গল স্ক্রিনের কর্ণধারদের বিপুল টাকার ব্যবসা দিচ্ছে 'পুষ্পা টু'। সূত্রের খবর, দক্ষিণী ছবিটি প্রথম সপ্তাহে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ২০ কোটির বেশি টাকার ব্যবসা করেছে। এই সপ্তাহ পার হয়ে গেলেই ছুটির আমেজ চলে আসবে। তখন হিন্দি সিনেমা দেখতে ভিড় আরো বাড়বে।
এর ফলে বড়দিন ও নতুন বছরের সপ্তাহে বাংলা ছবির জন্য কোন সুখবর থাকছে না, এই অনুমান করা যায়। সমস্যার সমাধান খুঁজতে বৃহস্পতিবার প্রযোজকদের সঙ্গে মাল্টিপ্লেক্স ও হল মালিকদের দফায় দফায় বৈঠক হয়। সূত্রের খবর, উভয় পক্ষের মধ্যে যথেষ্ট চাপানোউতোর হয়েছে। কেন বাংলা ছবি পশ্চিমবঙ্গেই প্রদর্শনের সুযোগ থাকবে না, এই প্রশ্ন তুলেছেন প্রযোজকরা। পাল্টা আর্থিক কারণ সামনে এনেছেন হল মালিকরা।
তাদের বক্তব্য অবশ্য আলাদা। মাল্টিপ্লেক্স কর্তাদের দাবি 'পুষ্পা টু'র পাশাপাশি আইনক্স, পিভিআর-এর মতো প্রথম সারির মাল্টিপ্লেক্সে দেখানো হবে 'সন্তান' ও 'খাদান'। যদিও 'চালচিত্র' এবং '৫ নং স্বপ্নময় লেনের' ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়।
রাজ্য সরকার ২০১৮ সালে চলচ্চিত্র আইন সংশোধন করে৷ এই সংক্রান্ত নির্দেশিকায় বলা হয়, জিটিএ এলাকা ছাড়া সব সিঙ্গল স্ক্রিন এবং মাল্টিপ্লেক্সে প্রাইম টাইমে, অর্থাৎ দুপুর ১২টা থেকে রাত নটার মধ্যে বছরে অন্তত ১২০ দিন ন্যূনতম একটি শো-এ বাংলা সিনেমা দেখানো বাধ্যতামূলক৷ সেই নির্দেশিকা বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
কলকাতার অন্যতম মাল্টিপ্লেক্স পিভিআর আইনক্স-এর ইউনিট হেড কুন্তল ঘোষ বলেন, "মাল্টিপ্লেক্স এর ব্যবসা সিনেমার কনটেন্ট-এর উপর হয়। আঞ্চলিক ছবি আসবে, আমাদের শো দিতে তো হবেই।
আমরা আঞ্চলিক ছবির বুকিং আগে ওপেন করিয়ে দিচ্ছি। এখনো পর্যন্ত আমরা পুষ্পা টু বুকিং ওপেন করিনি। খাদান, সন্তান রিলিজ করছে। অনেকগুলো করে শো চালাচ্ছি।সরকার থেকে নিয়ম করে দিয়েছে নির্দিষ্ট সংখ্যক আঞ্চলিক ছবি দেখানোর। পুজোর সময় আমরা বাংলা মুভিকেই অগ্রাধিকার দিয়েছি।"
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যার অধ্যাপক মানস ঘোষ ডিডাব্লিউকে বলেন, "সরকার একটা আইন করতে পারে। কিন্তু সরকারের পক্ষে এটা কার্যকর করা মুশকিল, যতদিন না এখানে সঠিক নিয়মনীতি মেনে কাজ হচ্ছে। বাংলা ছবি রিলিজের ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি, যারা ছোট পরিবেশক বা স্বাধীন পরিচালক(যেমন প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী), নির্দিষ্ট দুটো-তিনটে গোষ্ঠীর সঙ্গে যারা যুক্ত নন, তারাও হল পান না। এর একটা বড় কারণ হল বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ভেতরের এক ধরনের রাজনীতি এবং ওই গোষ্ঠীরগুলির একাধিকপত্য। এরা নিজেরাই বাংলা ছবির সবচেয়ে বড় ক্ষতি করে। তারপর যখন অন্য ছবি এসে হল পেয়ে যায় বা হিট হয়ে যায়, তখন এরা কাঁদুনি গাইতে শুরু করে যে বাংলা ছবিকে বাঁচানোর জন্য সরকার কিছু করছে না।"
তাহলে কি বাংলা ছবির গুণমান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে? অতীতে পাঠান বা আরআরআর ছবির ক্ষেত্রেও দেখা গেছে বাংলা ছবি হল পায়নি। অধ্যাপক বলেন, "বাংলা ছবির একমাত্র দর্শক হচ্ছে শহুরে মধ্যবিত্ত, নব্যধনী সম্প্রদায়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার রিভিউতে বাংলা ছবিগুলোর যে প্রশংসা করা হয়, তা অন্তঃসারশূন্য। এই ছবিগুলো ওই উক্ত দুটি-তিনটি গোষ্ঠী দ্বারাই তৈরি করা হয়। ফলে তারা নিজেরাই বাংলা ছবিকে কোনও না কোনও ভাবে সীমাবদ্ধ করেছে নির্দিষ্ট গণ্ডিতে। বাংলা ছবি যে নিজে স্বনির্ভর হতে পারছে না, তার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, গোষ্ঠীগুলির হাতে পুরো ক্ষমতাটা কেন্দ্রীভূত হওয়া। তার উপর বাংলা ছবিতে আর বিনিয়োগও নেই। বাজার কীভাবে বাড়াতে হবে, সেই স্ট্র্যাটেজি ভাবতে হবে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে। যেটা তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালায়ালাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ভাবতে পেরেছে।"
চলচ্চিত্র পরিচালক অশোক বিশ্বনাথন ডিডাব্লিউকে বলেন, "বাংলা ছবি এমনিতেই নানা কারণে কোণঠাসা। স্বল্পসংখ্যায় বাংলা ছবি যদি না মুক্তি পেতে পারে, তাহলে প্রযোজকরা কেন টাকা লাগাবেন, এই শিল্প মৃত হয়ে যাবে।"
তিনি মনে করেন, "হিন্দি ছবি বা প্যান ইন্ডিয়ান ছবি (যেমন, পুষ্পা বা আরআরআর) আপাতভাবে অনেকটা চাকচিক্যপূর্ণ। সব সময় অর্থ দিয়েই ভালো ছবি তৈরি হয় না। অভিনব বিষয় এবং আঙ্গিক দিয়ে যদি স্বল্প অর্থে আমরা ভাল বাংলা ছবিতে করতে পারি ,তাহলেই সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র দেখে বাংলা ছবির মানটাকে আর উন্নত করতে হবে।"
বাংলা ছবির নিজস্ব টানাপোড়েন
অনেকে মনে করছেন, উৎসবের মৌসমে একসঙ্গে এতগুলো ছবি নিয়ে এলে ব্যবসায়িক সমস্যা হওয়া খুব স্বাভাবিক। হিন্দি বা দক্ষিণী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি একই কারনে একসঙ্গে দুটোর বেশি ছবিমুক্তির পথে হাঁটে না।
কুন্তল ঘোষ ডিডাব্লিউকে বলেন, "এটা মূলত সিঙ্গল স্ক্রিনের সমস্যা। পুষ্পা টু-র সময় প্রায় চার ঘন্টা। দিনে তিনটে শো চালালেই সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি পুষ্পা টু যখন রিলিজ করেছে, তখন কোনও সিনেমা রিলিজ করেনি। বাংলা সিনেমার প্রডিউসার, ডিস্ট্রিবিউটাররা এই সমস্যা চিহ্নিত করতে পারবেন। একইসঙ্গে চারটি সিনেমা রিলিজ করার দরকার ছিল না। ওদের নিজেদের মধ্যেই এই সংঘর্ষ লাগছে। পুষ্পা টু-কে আমি বাদ দিয়ে যদি বলি দর্শক চারটি বাংলা ছবির মধ্যে একটাকে বেছে নেবেন। দর্শক তো এখানেই বিভাজিত হয়ে যাচ্ছে।"
কলকাতার পুরোনো সিনেমা হলগুলির মধ্যে অন্যতম একটি হলো ‘প্রিয়া'৷ এই প্রেক্ষাগৃহের কর্ণধার ও প্রযোজক অরিজিৎ দত্ত ডিডাব্লিউকে বলেন, "যে ছবি চলছে, সেই ছবি নামানো যায় না। গত দু সপ্তাহ পুষ্পা টু সমস্ত হলে চলেছে, ব্যবসা দিয়েছে এবং এখনো দিচ্ছে। চারটে বাংলা ছবি একসঙ্গে আসার দরকার কি ছিল? ছড়িয়ে ছিটিয়ে আসতে পারতো, দুটো আসতে পারতো এখন, বাকি দুটো পরে আসতো। তাতে কোন সমস্যা ছিল না। সব সময় বাইরের ছবিকে দোষ দেয়া হয় কেন?"
অশোক বিশ্বনাথন বলেন, "অবশ্যই পরিবেশক এবং প্রদর্শককে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে স্বল্প সংখ্যক বাণিজ্যিক কিংবা তথাকথিত শিল্প-সম্মত বাংলা ছবি দেখানোর কিছুটা জায়গা দিতেই হবে। এটাকে সমর্থন বা সংরক্ষণ যাই বলুন না কেন, সম্মিলিতভাবে এটা করতে হবে। তাহলে এই বাংলা ছবি বাঁচতে পারে।"
শুধু দক্ষিণী ছবির কারণে বাংলা ছবি ব্যবসা পায় না এমনটা ঠিক নয়। বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নিজস্ব অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, টানাপোড়েন বাংলা ছবিকে অনেকটা পিছিয়ে দিচ্ছে। মানস ঘোষের বক্তব্য, "ছবি তৈরি আর রিলিজ করা আলাদা বিষয়। সেখান থেকে রেভিনিউ অর্জন করাটাও। এই বাণিজ্যিক জায়গায় আজকের গ্লোবালাইজেশনের বাজারে প্রত্যেককেই প্রতিযোগিতার মধ্যে টিকে থাকতে হয়। দুটি--তিনটি গোষ্ঠীর পরিবেশক, প্রযোজকরা খোলা বাজারের ওপেন প্র্যাক্টিসকে নিজেদের ক্ষেত্রে অনুসরণ করেন না। তারা নিজেরাই ৪০ শতাংশ বাংলা ছবিকে পেছনে ঠেলে দেন। এরপর দক্ষিণের ছবি বাজার দখল করে নিলে এরা কান্নাকাটি করেন। সঠিক নিয়ম নীতি মেনে চললে পুরো ইন্ডাস্ট্রিতেই সেটা করা উচিত। বাংলা ছবির সার্বিক উন্নতি যদি সম্ভব হয়, তাহলে আর এই কথাগুলো উঠবে না।"
তাহলে বাংলা ছবি দর্শক টানতে পারছে না? সেজন্যই কি রমরমিয়ে নিয়ে চলছে পুষ্পা টু এর মতো ছবি? অরিজিৎ দত্ত বলেন, "বাইরের ছবিগুলি ৫০ সপ্তাহের ব্যবসা দিচ্ছে। বাংলা ছবি চার- পাঁচটা করে আসছে পুজো, বড়দিন, পয়লা বৈশাখে। কী করে সব ছবিকে জায়গা দেয়া যাবে? আমরা কি দুই সপ্তাহ নিয়ে ভাবব? আমাদের বছরের বাকি সপ্তাহ নিয়েও ভাবতে হবে। আমাদের তো বাইরের ছবি বাঁচাচ্ছে। তখন তো বাংলা ছবি একটাও নেই।"