পড়ে থাকে পারে, ভাসে লাশ ইছামতির জলে
২০ ডিসেম্বর ২০২৪‘বেওয়ারিশ' মরদেহের ঠাঁই হয় আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামে।
যশোরের শার্শা সীমান্তে ইছামতি নদীর পাড় থেকে গত বুধবার একদিনে তিন যুবকের মরদেহ উদ্ধার বরে পুলিশ। সকালে নদীর পাড় থেকে দুইজন এবং পরে নদীতে ভাসমান অবস্থায় একজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
বুধবার বিকালে শার্শা থানার অগ্রভুলোট সীমান্তের ইছামতী নদী থেকে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করা হয় সাকিবুর রহমান নামের এক যুবকের মরদেহ। সাকিবুর বেনাপোল পোর্ট থানার দীঘিরপাড় গ্রামের জামিলুর রহমানের ছেলে। এর আগে সকালে একই এলাকার আরিফুল ইসলামের ছেলে সাবু হোসেন ও একই থানার কাগজপুকুর গ্রামের ইউনুস আলীর ছেলে জাহাঙ্গীর আলমের মরদেহ সীমান্তের পাঁচভুলোট ও পুটখালী থেকে উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ ও পরিবার যা বলছে
একে একে তিনজনেরমরদেহ উদ্ধারের পর সাকিবুর রহমান ও জাহাঙ্গীর আলমকে হত্যার অভিযোগে শার্শা থানায় দুইটি এবং সাবু হোসেনকে হত্যার অভিযোগে বেনাপোল পোর্ট থানায় একটি মামলা হয়। তিনটি মামলাতেই অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিরা আসামি। বেনাপোল পোর্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাসেল মিয়া বলেন, "সাবুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করি। তার মাথা, বুকসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ১০-১২টি আঘাতের চিহ্ন আছে। লাশের সুরতহাল ও ময়না তদন্ত হয়েছে।”
"উদ্ধারের সময়ও সে জীবিত ছিল। তাকে বাসায় নেযার পর সে মারা যায়। তাকে কোনো প্রশিক্ষিত বাহিনীর লোকজন পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে ধারণা করছি।”
দিনমজুর সাবু হোসেনের বোন স্বপ্না বেগম বলেন, "তাকে কাজের কথা বলে একজন লোক বাসা থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর আমরা তার লাশ পড়ে থাকার খবর পাই। কারা হত্যা করেছে, তা আমরা বলতে পারছি না। পুলিশ তদন্ত করে অপরাধীদের চিহ্নিত করুক।”
নিহত জাহাঙ্গীর আলমের ভাই আলমগীর হোসেন জানান তার ভাইয়ের শরীরে অনেক আঘাতের চিহ্ন ছিল। তাকে বেদম পিটানো হয়েছে, বুকে,মাথায় সবখানেই আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। তিনি বলেন, " আমার দিনমজুর ভাইকে কারা কী কারণে হত্যা করেছে আমরা বলতে পারি না। তাই মামলায় কাউকে আসামি করিনি।”
সাকিবুর রহমানের নানা জবেদ আলী বলেন, "সে গাড়ির হেলপারের কাজ করতো। দুপুর বেলা সেই কাজেই বাসা থেকে বের হয়ে যায়। তারপর আমরা তার লাশ পাই। তাকে পিটিয়ে তার মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে ফেলা হয়েছে, নাক ও মাথায় আঘাত করা হয়েছে। তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। কে মেরেছে তা জানি না। তাই মামলায় কাউকে আসামি করিনি।”
এলাকার তিন যুবকের মরদেহ উ্দ্ধার এবং হত্যাকাণ্ডের তদন্ত সম্পর্কে শার্শা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আমির আব্বাস বলেন, " তাদের সুরতহাল ও ময়না তদন্ত হয়েছে। তাদের প্রচণ্ডভাবে আঘাত করে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাদের শরীরে অনেক আঘাতের চিহ্ন আছে। আমরা চেষ্টা করছি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার করতে। তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে কাউকে সন্দেহ না করায় তদন্ত একটু জটিল।”
তবে স্থানীয় পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, নিহত তিনজনই সীমান্তের ওপার থেকে ভারতীয় গরু আনার কাজ করতেন। হত্যাকাণ্ডে সেই বিষয়টির কোনো ভূমিকা থাকতে পারে বলে মনে করেন কেউ কেউ৷
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু পড়ে থাকা লাশ উদ্ধারের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে৷মরদেহ দেখে মনে হয়েছে বেশিরভাগই হত্যাকাণ্ডের শিকার৷ তবে অনেক লাশেরই পরিচয় মিলছে না বলে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হচ্ছে।
গত ১৯ ডিসেম্বর ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকার সায়দাবাদ ফ্লাইওভারের নিচ থেকে কামরুল হাসান (২৩) নামে এক তরুণের লাশ উদ্ধার করা হয়। জানা গেছে, নিহত কামরুল বন্ধুদের সঙ্গে কক্সবাজার যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন।
১৭ ডিসেম্বর ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ধামরাই উপজেলার জয়পুরা এলাকায় পরিত্যক্ত একটি ডোবা থেকে অজ্ঞাত পরিচয় এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
১৩ ডিসেম্বর রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে ফুটপাত থেকে অজ্ঞাতনামা এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ফুটপাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা নারীর বয়স আনুমানিক ২৫ বছর।
ঢাকার বাইরেও গত দেড়মাসে উদ্ধার করা হয়েছে বেশ কিছু লাশ৷গত ৩ নভেম্বর পাবনার পদ্মা নদী থেকে ১২ বছরের এক কিশোর এবং ২২ বছরের এক তরুণীর অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করেন নাজিরগঞ্জ নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা। তাদেরও পরিচয় পাওয়া যায়নি।
পুলিশ সদর দপ্তরের নথিভুক্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সারা দেশে খুনের শিকার হয়েছেন ৫৮৩ জন, অক্টোবর মাসে ৩৯৯ জন এবং নভেম্বরে ৩৩৭ জন।২০২৩ সালে এই তিন মাসে খুনের ঘটনা কম ছিল। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ২৩৮ জনের খুনের ঘটনা নথিভুক্ত হয়, অক্টোবর মাসে ২৫৮ জন এবং নভেম্বর মাসে নথিভুক্ত হয় ২২৭ জনের খুনের ঘটনা। দুই বছরে রাজধানীর তথ্যেও ব্যবধান খুব স্পষ্ট৷ রাজধানী ঢাকায় চলতি বছরের নভেম্বরে খুনের মামলা হয়েছে ৫৫টি, অক্টোবরে ৫৭টি ও সেপ্টেম্বরে ১৪৮টি। ২০২৩ সালের এই সময়ে খুনের ঘটনায় মামলা ছিল যথাক্রমে নভেম্বরে ১৭টি, অক্টোবরে ১৯টি ও সেপ্টেম্বরে ১২টি। তবে পুলিশের হিসাবে কজনের পরিচয় মেলেনি তার উল্লেখ নেই।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, "৫ আগস্টের পর এখনো পুলিশের ঢিলেঢালা ভাবের তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। আমার মনে হয়, এর সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। গুপ্ত হত্যা হচ্ছে। পরিচয় মিলছে না নিহতের। অপরাধীরাও চিহ্নিত হচ্ছে না। পুলিশের চেষ্টা আছে বলেও মনে হয় না। আর অপরাধের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে।”
তার কথা, "অপরাধীরা যদি মনে করে পার পাওয়া যাবে, তাদের চিহ্নিত করা যাবে না, তাহলে এই ধারনের হত্যাকাণ্ড বাড়বে।”
এ প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান বলেন," এই ধরনের পরিস্থিতির কথা আগে শুনিনি। গুপ্ত হত্যা বা বেওয়ারিশ লাশ বেড়ে যাওয়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতার কারণেই হচ্ছে। অপরাধীরা সুযোগ নিচ্ছে। লাশের পরিচয় মুছে দেয়ার কৌশল নিচ্ছে তারা।”
তার মতে, "এইসব ঘটনায় জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। আমরা দায়িত্বে অবহেলার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে কাউকে শাস্তি দেয়া হয়েছে বলে শুনিনি।”
বেওয়ারিশ লাশের অন্তিম ঠিকানা
বাংলাদেশে বেওয়ারিশ লাশ দাফনে যারা নিয়োজিত আছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো বেরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আঞ্জুমান মফিদুল ইসালাম। তাদের কাছে গত ১১ মাসে ঢাকা শহর থেকে ৫১৬টি বেওয়ারিশ লাশ পাঠিয়েছে পুলিশ এবং তারা ওই লাশগুলো দাফন করেছে। তারা জনুয়ারি মাসে ৪৪টি, ফেব্রুয়ারিতে ৩৩, মার্চে ৪৯, এপ্রিলে ৩৭, মে মাসে ৫৯, জুনে ৩৪, জুলাই মাসে ৮১, আগস্টে ৩৪, সেপ্টেম্বরে ৩৪, অক্টেবরে ৪৪ এবং নভেম্বরে ৫৩টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে।
প্রতিষ্ঠানটির দাফন অফিসার মো. কামরুল ইসলাম জানান, "বেওয়ারিশ শুধু পুলিশই ঘোষণা করতে পারে। পুলিশ আমাদের জানানোর পর তার লাশ আমাদের দিয়ে যায় বা হাসপাতাল থেকে আমরা নিয়ে আসি। আমরা লাশের ছবি ও কাগজপত্র সংগ্রহ করি। লাশের সুরতহাল এবং ময়না তদন্তের পর আমাদের দেয়া হয়। আর প্রত্যেকটি ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা হয়। এর বাইরে আমাদের লাশ গ্রহণের সুযোগ নেই।”
"প্রতিদিনই নিখোঁজ আত্মীয়-স্বজনের খোঁজে লোকজন আমাদের কাছে আসেন। কেউ যদি ছবি দেখে শনাক্ত করতে পারেন, তাহলে আবার থানাকে আমরা জানাই। আইনি প্রক্রিয়ায় পরিবার চাইলে লাশ থানাই তাদের দেন। যেভাবে হস্তান্তর করা সম্ভব হস্তান্তর করা হয়। এরকম বেশ কিছু বেওয়ারিশ লাশ পরে তাদের পরিবার চিহ্নিত করে,” বলেন তিনি।
"যাদের লাশ আসে, তাদের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে আমাদের জানানো হয় না আর জানা আমাদের কাজও নয়,” বলেন তিনি। তবে একজন কর্মকর্তা জানান, "অধিকাংশ লাশের শারীরেই আঘাতের চিহ্ন থাকে। কোনো কোনো লাশ আবার বিৃকত হয়ে যায়। হতে পারে অপরাধীরা হত্যার পর লাশ বিকৃত করে, যাতে চেনা না যায়। তবে স্বাভাবিক মৃত্যুর লাশও আসে।”
২০২৩ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম সারাদেশে ১৩ হাজার ৩২৪টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে। প্রতিবছর গড়ে তারা এক হাজারেরও বেশি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে।
অজ্ঞাত লাশ ও পুলিশের তৎপরতা
শার্শা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আমির আব্বাস তার অভিজ্ঞাতার আলোকে বলেন," অজ্ঞাত লাশের শেষ গন্তব্য আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম। আমরা লাশের ছবি, আলামত, প্রাপ্ত ডকুমেন্ট সংরক্ষণ করি। ডিএনএ টেস্ট করেও রাখা হয়। সুরতহাল ও ময়না তদন্তের ভিত্তিতে হত্যা মামলা হয়। আর সেরকম কিছু না হলে অপমৃত্যুর মামলা হয়।”
তিনি জানান, "পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন(পিবিআই) সদর দপ্তরে একটি সফটওয়্যার আছে। যদি অজ্ঞাত লাশটি তালিকাভুক্ত কোনো অপরাধী হয়, তাহলে তার পরিচয় ওই সফটওয়্যার থেকে জানা যায়।”
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি(মিডিয়া) ইনামুল হক সাগরের দাবি, "পুলিশ এখন পুরোদমে কাজ করছে। পুলিশের ভিতরে কোনো ঢিলেঢালা ভাব নেই। আর প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এবং আসামিদের গ্রেপ্তারে তৎপর আছে পুলিশ। তবে অপরাধের নানা সিজন আছে। বছরের কখনো কখনো হত্যা বেড়ে যায় আবার এলাকাভিত্তিকও অপরাধ কম-বেশি হয়।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন," পুলিশে এমন কোনো পরিস্থিতি হয়নি যে, তার সুযোগ নেবে অপরাধীরা। পুলিশ সব সময় তৎপর আছে।”
"হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিসহ বেওয়ারিশ লাশের পরিচয় শনাক্ত করার আমরা চেষ্টা করি। এজন্য আমাদের কিছু প্রক্রিয়া আছে। লাশের ডিএনএ টেস্ট, ফিঙ্গার প্রিন্ট, ছবি- এগুলো আমরা সংরক্ষণ করি।আরো অনেক পদ্ধতি আছে, যার মাধ্যমে আমরা পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করি,” বলেন তিনি।