ফিরে আসছে ‘এল নিনো'
১৬ আগস্ট ২০২৩এল নিনো হচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি একটি জলবায়ু প্যাটার্ন যার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্য, সুপেয় পানি এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে বলে সতর্ক করেছে বিজ্ঞানীরা৷
টানা তিনবছর ‘লা নিনার' দাপটের পর গত মাসে ‘এল নিনোর' আবির্ভাবের কথা নিশ্চিত করেছে বিশ্ব আবহয়াওয়া সংস্থা৷ যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এল নিনো থাকার সম্ভাবনা ৯৫%৷
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত এল নিনোর এই চক্র স্থানীয়ভাবে খরা এবং ক্ষুধার পাশাপাশি প্রাণীবাহিত রোগের সংখ্যাও বাড়ানোর আশঙ্গা রয়েছে৷
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট অ্যান্ড সোসাইটির বিজ্ঞানী ওয়াল্টার ব্যাথগেন বলেন, ‘‘এল নিনোর অর্থ এই নয় যে, বিশ্বব্যাপী এবছরে অন্য বছরের চেয়ে বেশি দুর্যোগ হবে৷'' তিনি বলেন, ‘‘এটি বিশ্বের বিভিন্ন অংশে গুরুতর স্থানীয় প্রভাব ফেলতে পারে৷''
উষ্ণায়ন বনাম শীতলীকরণ
‘এল নিনো' এবং ‘লা নিনা' হলো ‘এল নিনো-সাউদার্ন অসকিলেশন (ইএনএসও) নামক আবহাওয়ার প্যাটার্নের দুটি অংশ, যা ক্রান্তীয় পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের উপর বাতাসের ধরন এবং সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রার একটি অনিয়মিত কিন্তু পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন৷
‘এল নিনো' বলতে ইএনএসও-র উষ্ণায়ন পর্যায়কে বোঝায়৷ অন্যদিকে ‘লা নিনা' বোঝায় এর শীতলকরণ পর্যায়কে৷
‘এল নিনো'-র বছরগুলিতে তাপমাত্রা প্রায় ০.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়ে থাকে যা ‘লা নিনা'-র সময়ে প্রায় একই পরিমাণে হ্রাস পায়৷ দুই প্যাটার্নের উঠানামার ঘটনাটি প্রায়শই একটি নিরপেক্ষ পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যায়৷
রেকর্ড তাপমাত্রার সম্ভাবনা
সাম্প্রতিক বছর এবং মাসগুলোতে পৃথিবী বারবার রেকর্ড তাপমাত্রায় পৌঁছেছে৷ বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) মতে, জুলাই ২০২৩ এর গড় তাপমাত্রা রেকর্ডের সর্বোচ্চ ছিল, যা ১৯৯১ থেকে ২০২১ সালের জুলাইয়ের গড়ের তুলনায় ০.৭২ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণ৷
ডব্লিউএমও-র জলবায়ু পরিষেবার প্রধান ক্রিস হিউইট বলেন, এল নিনোর প্রভাবে ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেশি৷
তিনি মনে করেন, ‘‘তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ আমাদের আভাস দিচ্ছে যে, প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়ে যাওয়ার ৬৬% সম্ভাবনা রয়েছে ৷''
তবে ২০২৪ সালে ‘এল নিনো'র প্রভাব সম্পূর্ণরুপে স্পষ্ট হবে৷ পৃথিবী পরবর্তী অর্ধ দশকে তার উষ্ণতম বছরের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে৷
স্থানীয় খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি
বেথগেন বলেন, খরা এবং খাদ্য নিরাপত্তার হুমকির মতো সম্ভাব্য প্রভাবের জন্য আরও ভালভাবে প্রস্তুতি নেয়ার জন্য জলবায়ু বিজ্ঞানীদের জন্য ‘এল নিনোর' বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ৷
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে এল নিনো ধানের ফসল কাটার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে৷ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ ইতিমধ্যে ফসল মজুদ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিচ্ছে৷ উদাহরণস্বরূপ, ভারত অনেক ধরনের চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে৷ অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়ার কিছু অংশ দ্রুত ফসল কাটার পরিকল্পনা করছে৷
‘এল নিনো'র কারণে প্রায়ই দক্ষিণ এশিয়ায় বিপজ্জনক তাপপ্রবাহ হয়৷
স্বাস্থ্যের উপর এল নিনোর প্রভাব
এল নিনোর বছরগুলিতে তাপের আকস্মিক পরিবর্তন সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে৷
বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান গ্রেগরি ওয়েলেনিয়াস বলেন, ‘‘গত বছর ইউরোপে তাপজনিত কারণে আরও ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্য যে কোনও মারাত্মক আবহাওয়ার তুলনায় তাপপ্রবাহে বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে৷''
হঠাৎ উষ্ণ আবহাওয়া মানবদেহকে প্রভাবিত করে এবং কিছু গবেষণায় ‘তাপপ্রবাহ এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার' মধ্যে একটি যোগসাজশ দেখানো হয়েছে৷ তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে তাপের কারণে তৈরি সবচেয়ে সাধারণ নেতিবাচক স্বাস্থ্য প্রভাব হলো ম্যালেরিয়া এবং ডেঙ্গুর মতো ভেক্টর বাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব৷
জলবায়ু প্রভাব ও অভিযোজনের প্রধান মেডেলিন থমসন বলেছেন, ‘‘পূর্ববর্তী এল নিনোর বছরগুলিতে এই ধরনের অনেক প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা গেছে৷ উদাহরণস্বরূপ কেনিয়ায়, ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ সালে ‘এল নিনো'র সময়, মশার প্রজনন বৃদ্ধি অসম্ভব বেশি ছিল৷ পূর্ব আফ্রিকায় ব্যাপক ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল৷''
তিনি আরও জানান, ‘‘২০১৫ এবং ২০১৬ সালে শেষ এল নিনোর প্রভাবে সময় একই ধরনের নিদর্শন দেখা গিয়েছিল৷''
তবে এল নিনো সাধারণত ব্যাপক বৈশ্বিক বিপর্যয়ের পরিবর্তে এই ধরনের ভৌগোলিকভাবে স্থানীয় বা আঞ্চলিক ঘটনার মাধ্যমে বেশি প্রকাশ পায়৷
সুস্মিতা রামাকৃষ্ণান/এসএইচ