গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, শীতকালীন ছুটির আগে গত ১ ডিসেম্বর ছিল আদালতের শেষ কার্যদিবস৷
ওই দিন তিনটি মামলা না নেওয়ায় ১ জানুয়ারি থেকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের (১) বিচারক জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার মোহাম্মদ ফারুকের আদালত বর্জন করেন আইনজীবীরা৷ এরপর ২ জানুয়ারি ওই ট্রাইব্যুনালের এজলাসে বিচার চলাকালে বিচারক ফারুকের সঙ্গে আইনজীবীদের বাদানুবাদ হয় এবং তার একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে৷ ওই ভিডিওতে জেলা জজ শারমিন নিগারের বিরুদ্ধে অশ্লীল, ও কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দিতে দেখা যায়৷ ৪ জানুয়ারি জেলা বিচার বিভাগীয় কর্মচারি অ্যাসোসিয়েশন আদালতের সব এজলাসের দরজা ও প্রধান ফটকে তালা দিয়ে এক দিনের কর্মবিরতি পালন করে৷ ৫ জানুয়ারি আইনজীবীরা ৩ কার্যদিবসের কর্মবিরতির ডাক দেন৷
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ৫ জানুয়ারি আইনজীবী সমিতির সভাপতি, ও সম্পাদকসহ ৩ আইনজীবীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেন; এবং এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে তাদেরকে ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্টে হাজির হতে বলা হয়৷ এদিকে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা জজ শারমিন নিগারের বিরুদ্ধে অশ্লীল, ও কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দিয়ে বিচারকাজ বিঘ্নিত করার অভিযোগের ব্যাখ্যা দিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আইনজীবী সমিতির ২১ জন আইনজীবীকে তলব করেন৷ ২৩ জানুয়ারি তাদের হাজির হয়ে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে৷ উল্লেখ্য যে, ৫ জানুয়ারি সকালে কর্মচারিরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করলেও আইনজীবীদের কর্মবিরতি অব্যাহত আছে৷
পৃথিবীর যে কোনো দেশের বিচারবিভাগের সুষ্ঠু কার্যক্রম নির্ভর করে বেঞ্চ (বিচারকদের) ও বারের (আইনজীবীদের) সৌহার্দ্য ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার উপর৷ বিচারক ও আইনজীবী – কেউ কারো শত্রু নন, বরং পরস্পরের বন্ধু, সুহৃদ ও শুভাকাঙ্খী৷ একটি মামলা দায়ের, তার বিচার কার্যক্রম, ও তার চূড়ান্ত ফলাফল; অর্থাৎ মামলার রায় নির্ভর করে বিচারক ও আইনজীবীদের উত্তম বোঝাপড়া, নিষ্ঠা, এবং সাবস্ট্যানটিভ ও প্রসিডিউরাল আইন প্রয়োগে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করার ওপর৷ এতে করে কাঙ্খিত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবার উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হয়৷ শেষ পর্যন্ত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় কিনা এবং রায় বিচার প্রার্থীর কোনো কাজে লাগে কিনা - বাংলাদেশের বাস্তবতায় সেটি একটি জটিল প্রশ্ন৷
এ কথা বলছি এ কারণে যে, বাংলাদেশে মামলার যে খরচ, সেটি বহন করার আর্থিক সামর্থ্য অধিকাংশ মানুষের নেই৷ যিনি মামলা করেন, উকিলের ফি ও মামলার আনুষঙ্গিক খরচ বহন করতে গিয়ে তিনি প্রায় নিঃস্ব হয়ে যান৷ দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে মামলার নিষ্পত্তি হয় আশঙ্কিত হবার মতো বিলম্বে! যে মামলা ২ বছরে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা, সেটি নিষ্পত্তি হয় ৬/৭ বছরে, যে মামলা ৫ বছরে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা, তার নিষ্পত্তি হতে ১০, ১৫, এমন কি ২০-৩০ বছরের বেশি সময়ও লেগে যায়৷ ফলে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পরে মামলার রায় বিচারপ্রার্থীর কোনো কাজে লাগে না বললেই চলে৷ এ প্রসঙ্গে এ তথ্যটিও মনে রাখতে বলি যে, বর্তমানে বাংলাদেশের উচ্চ ও নিম্ন আদালতে ৩৫ লক্ষের অধিক মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ঝুলে আছে৷
এতদসত্ত্বেও এটি মানতে হবে যে, পাহাড়প্রমাণ সমস্যা সত্ত্বেও জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত কয়েক হাজার বিচারক আপ্রাণ চেষ্টা করছেন মামলা নিষ্পত্তি করতে৷ তবে এসকল বিচারকদের মধ্যে কারো কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির ভয়াবহ অভিযোগ আছে এবং এজন্য বেশ কিছু বিচারককে চাকুরি থেকে অপসারণও করা হয়েছে৷ অন্যদিকে জেলা শহরগুলোর বার, ঢাকা বার ও সুপ্রিম কোর্ট বারে আইনজীবী হিসেবে আইন চর্চা করছেন শত শত আইনজীবী৷ এসকল আইনজীবীর মধ্যে ভালো যেমন আছেন, আবার খারাপও আছেন৷ তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, আইনজীবীদের নানা প্রভাবশালী গ্রুপ বিচারালয়কে জিম্মি করে ফেলেন এবং তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী কিছু না হলে সংশ্লিষ্ট বিচারকের আদালত বর্জন করেন৷
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদালত অঙ্গনে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্খিত ঘটনার আদ্যেপান্ত জানার পরে আমার মনে হয়েছে যে, ওখানকার আইনজীবী সমিতি বিচারালয়কে জিম্মি করে ফেলেছে৷ নারী জজ সম্পর্কে অশালীন ভাষা প্রয়োগ করার স্পর্ধাও তারা দেখিয়েছেন৷ এমনকি তারা হাইকোর্টের রুলকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে তাদের ধর্মঘট অব্যাহত রেখেছেন৷ পরিবহণ মালিক ও শ্রমিকরা যেমন যাত্রীদের জিম্মি করেন, ইন্টার্নী ডাক্তাররা যেমন রোগীদের জিম্মি করেন, আইনজীবীরাও তেমনি তাদের আধিপত্য বজায় রাখা ও বাণিজ্যিক স্বার্থ জারি রাখার জন্য আদালত, বিচারক ও বাদী-বিবাদীদের জিম্মি করে ফেলেন৷ সমস্যা যা-ই হোক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তার সুরাহা করতে পারতেন৷ আইনের পেশাজীবী হিসেবে উচ্চ আদালতের শুনানি, রুলিং ও চূড়ান্ত রায়ের ওপরও তাদের শ্রদ্ধা রাখা উচিত ছিল৷
যা-ই হোক, পরিশেষে বলতে চাই যে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অচলাবস্থার জন্য দায়ী আইনজীবীদের আদালত অবমাননার জন্য শাস্তি দেওয়া আইনের শাসনের স্বার্থেই প্রয়োজন৷ বিশেষ করে যে সকল আইনজীবী নারী বিচারক সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করেছেন, তাদের আইনজীবীর লাইসেন্স বাতিল করে ফৌজদারি শাস্তির আওতায় আনা দরকার৷ বিচার অঙ্গনে আইন পেশার নামে কোনোভাবেই যা খুশি তাই চলতে পারে না৷