দ্রুত চিকিৎসাই ক্যানসার ঠেকানোর সেরা দাওয়াই
৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩মারণব্যাধি ক্যানসার ধনী-দরিদ্র ভেদ মানে না৷ তার কাছে বিশিষ্ট ও সাধারণের মধ্যে কোনো সীমারেখা টানা নেই৷
সঙ্গীতশিল্পী স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত৷ ২০১৯ সালে তার ক্যানসার ধরা পড়ে৷ দীঘল কেশের প্রিয় শিল্পীর চেহারা এখন অচেনা৷ তবু ক্যানসারের সঙ্গে সুরের সফর বজায় রেখেছেন রবীন্দ্রগানে দুই বাংলার প্রিয় শিল্পী৷
‘মহীনের ঘোড়াগুলি' গানের দল বাংলা সঙ্গীত জগতের এক মাইলফলক৷ তার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তাপস বাপি দাস এখন শয্যাশায়ী৷ তার ফুসফুস ক্যানসার তৃতীয় পর্যায়ে৷ ৬৮ বছর বয়সি মানুষটির ওজন অনেক কমে গিয়েছে৷ হিমোগ্লোবিনের মাত্রা নিম্নমুখী৷
সোশ্যাল মিডিয়ায় শিল্পীর অসুস্থতার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরই অনেকে অর্থ সাহায্য করেছেন৷ এখন রাজ্য সরকার চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব নিয়েছে৷
বাপি দাসের স্ত্রী সুতপা ঘোষ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কাল থেকে শরীরটা বেশ খারাপ৷ রাত থেকে টানা অক্সিজেন চলছে৷ হয়তো হাসপাতালে ভর্তি করতে হতে পারে৷ এই দিনটা ওর কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷ আজ বাপির জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হবে৷ বইমেলায় আমাদের যাওয়ার কথা ছিল৷’’
তাপস বাপি দাস একা নন৷ এই লড়াইয়ের মধ্যেই সৃষ্টিশীল মনটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন নাট্যব্যক্তিত্ব চন্দন সেন, লোকশিল্পী শুভেন্দু মাইতি৷
তবে কেউ কেউ হার মেনেছেন মারণ রোগের কাছে৷ কিছুদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা শর্মা৷ অনেক কম বয়স থেকে তিনি ক্যানসারে ভুগছিলেন৷
বাংলার গণ্ডি পার করলে প্রয়াত অভিনেতা ঋষি কাপুরের কথা প্রথমে মনে পড়ে৷ ক্রিকেটার যুবরাজ সিং, অভিনেত্রী সোনালি বেন্দ্রের লড়াই কুর্নিশ জানানোর মতো৷
এই বিশিষ্টজনের কথা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়৷ কিন্তু ভারতের ঘরে ঘরে লাখ লাখ ক্যানসার রোগীর সংগ্রাম, বেদনা আড়ালে থেকে যায়৷
২০২২ সালের হিসেব অনুযায়ী, এদেশে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ৷
ইন্ডিয়ান জার্নাল অব মেডিক্যাল রিসার্চের সমীক্ষায় আরো ভয়াবহ ইঙ্গিত মিলেছে৷ তাতে বলা হয়েছে, ভারতীয় পুরুষদের মধ্যে প্রতি ৬৭ জনের একজনের ফুসফুসের ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থাকে৷ ২৯জন নারীর মধ্যে একজনের স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ভয় রয়েছে৷
তাই চিকিৎসায় বিলম্ব সম্পর্কে সতর্ক করছেন চিকিৎসকরা৷ ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. ইন্দ্রনীল খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই রোগের সত্যিটা মেনে নেওয়াটাই সবচেয়ে বড় কাজ৷ দ্রুত চিকিৎসা শুরু না করে বারবার একই পরীক্ষা করে লাভ নেই৷ হ্যাঁ-কে না প্রমাণ করার চেষ্টায় দেরি হয়ে যায়৷ তাতে পরিস্থিতি খারাপ হয়৷ ছড়িয়ে পড়ে ক্যানসার৷’’
এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি ১০ জন ভারতীয়ের একজন ক্যানসারে আক্রান্ত৷ প্রতি ১৫ জনের একজন মারা যান৷ সমীক্ষা বলছে, ফুসফুস ও মুখের ক্যানসারে বেশি মানুষ আক্রান্ত হন৷ আক্রান্ত নারীদের ৪০ শতাংশের হয় স্তন ক্যানসার৷
মেডিক্যাল জার্নাল ‘ল্যানসেট’-এর তথ্য, পৃথিবীতে জরায়ুমুখ ক্যানসারেমৃতদের ২৩ শতাংশ ভারতীয়৷ তবে যে ক্যানসারই হোক, দ্রুত চিকিৎসা শুরু না করলে বিপদ ঘটতে পারে৷
এই আসন্ন বিপদ, রোগের লক্ষণ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে প্রয়াসী সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা৷ কলকাতার ‘হিতৈষিণী' ১৯৯৫ থেকে এই লক্ষ্যে কাজ করছে৷ স্তন ক্যানসার আক্রান্তরাই কাউন্সেলিং করেন রোগীদের৷ প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দেন৷
পূর্ব মেদিনীপুরের ‘প্রয়াস’ ১২ বছর ধরে ক্যানসার আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করছে৷ ৪ ফেব্রুয়ারি তারা যৌথভাবে ‘মাস রুরাল ইনিশিয়েটিভ'-এর সঙ্গে দিনটি পালন করে৷
‘প্রয়াস'-এর আদিত্য মান্না ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রোগীদের কাউন্সেলিং করাই৷ তার পাশাপাশি পুনর্বাসনে আমরা জোর দিই৷’’
‘হিতৈষিণী'-র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, স্তন ক্যানসারজয়ী বিজয়া মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেরি করে চিকিৎসা শুরু হলে লাভ নেই৷ স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে প্রথমে যন্ত্রণা থাকে না৷ লজ্জাও পান অনেকে৷ তাই গোড়াতে চিকিৎসা শুরু করেন না৷ দেরিতে চিকিৎসা শুরু করলেও খরচের ধাক্কায় অনেকে পিছিয়ে যান৷’’
কোভিড অতিমারির পর্বে সত্যিই বিলম্ব হয়েছে চিকিৎসায়৷ লকডাউন, যোগাযোগের সমস্যাসহ অন্যান্য প্রতিকূলতায় অনেকে নিয়মিত চিকিৎসা করাতে পারেননি৷ ফলে কোভিড-উত্তর পর্বে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে রোগের প্রাবল্য৷
এই পরিস্থিতিতে বেসরকারি উদ্যোগ পর্যাপ্ত নয়, মূল ভূমিকা সরকারের, এমনটাই মনে করেন চিকিৎসকদের বড় অংশ৷ সার্ভিস ডক্টর্স ফোরামের সম্পাদক ডা. সজল বিশ্বাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে৷ রাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হবে রোগাক্রান্তদের পাশে৷ নইলে এর মোকাবিলা করা যাবে না৷’’
কলকাতা থেকে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে বাড়ছে ক্যানসার রোগীদের ভিড়৷ সরকারি হাসপাতালে কেমোথ্যারাপি থেকে ওষুধ মেলে বিনামূল্যে৷ কিন্তু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় অপেক্ষা ও হয়রানিও বাড়ে৷ কঠিন অসুখে আক্রান্ত মানুষের পক্ষে যা দুঃসহ৷
কেন বাড়ছে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা? পরিবেশ দূষণের কারণে ক্যানসার বেড়ে থাকতে পারে বলে মত দেন ডা. খান৷
তিনি বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে আমরা দেখছি, গাঙ্গেয় এলাকায় গল ব্লাডার ক্যানসার বাড়ছে৷ এর কারণ খোঁজা হচ্ছে৷ তবে নদীর তীরে ৫০-৬০ বছর বা তার আগে যে শিল্প তৈরি হয়েছিল, তার দূষণ থেকেও এই ক্যানসার বেড়ে থাকতে পারে৷’’
এই পরিস্থিতে প্রতি জেলায় ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র তৈরি করা দরকার, এমনটাই মত চিকিৎসকদের৷ স্বাস্থ্যসাথী, আয়ুষ্মান ভারতের মতো প্রকল্পের সুবিধা যাতে ক্যানসার রোগীরা পান সেদিকেও জোর দিচ্ছেন তারা৷ তবে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন রোগী ও তার পরিবারের সচেতনতার৷
সুতরাং দেরি নয়, লক্ষণ দেখা দিলেই হাসপাতালে যেতে হবে৷ ক্যানসার দিবসে এটাই হোক শপথ৷ এমনটাই আহ্বান চিকিৎসকদের৷
২০২০ সালের গ্যালারি