1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারতে শঙ্কাময় অধিকাংশের শিক্ষার ভবিষ্যৎ

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড়
১০ জানুয়ারি ২০২৫

কয়েকদিন আগেই কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ভারতে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পরীক্ষা ফিরবে। পাস করতে না পারলে শিক্ষকরা বিশেষ ক্লাস নেবেন। পড়ুয়াদের আবার পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে হবে।

https://p.dw.com/p/4p1Hs
দীর্ঘদিন ধরে ভারতে সরকারি স্কুলে পাস-ফেলের বিষয়টিই ছিল না। একবার স্কুলে পড়া শুরু করলে একেবারে দশম শ্রেণিতে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হতো।
ভারতের একটি বিদ্যালয়ে একদল শিক্ষার্থী (প্রতীকী ছবি)ছবি: Manish Kumar/DW

দীর্ঘদিন ধরে ভারতে সরকারি স্কুলে পাস-ফেলের বিষয়টিই ছিল না। একবার স্কুলে পড়া শুরু করলে একেবারে দশম শ্রেণিতে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হতো।

পাস-ফেল না থাকায় কেউ কিছু শিখুক বা না শিখুক পরের ক্লাসে ঠিক উঠে যেতো। তার ফলে পরিস্থিতি এমন হয়েছে, ক্লাস এইটের বা নাইনের ছাত্র-ছাত্রী স্কুলে যায়, কিন্তু একপাতা বাংলা বা ইংরাজি ঠিকভা্বে পড়তে পারে না। সাধারণ যোগ-বিয়োগ করাও তাদের ক্ষমতার বাইরে। নামতাও জানে না তারা। তাই এখন আবার পরীক্ষা ব্যবস্থা ফেরাতে হলো সরকারকে।

কিন্তু তাতে কি পরিস্থিতি ঠিক হবে? ছাত্র-ছাত্রীরা কি পড়াশুনো করবে, শিখবে? এই প্রশ্নের উত্তর এককথায় দেয়া সম্ভব নয়। কারণ, এর সঙ্গে অনেকগুলি বিষয় জড়িয়ে আছে।

প্রথম কথা হলো, ভারতের সবকটি রাজ্যে দুইটি সমান্তরাল স্কুল চলে। সরকারি ও বেসরকারি। যত দিন গিয়েছে, ততই সরকারি স্কুলগুলির মান খারাপ হয়েছে, বেসরকারি স্কুলগুলি ফুলেফেঁপে উঠেছে। বেসরকারি স্কুলে তা-ও কিছুটা পড়াশুনো হয়। চাপের জন্য হোক বা প্রচুর পয়সা দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি করার জন্য হোক, সেখানে পড়ুয়াদের শেখানোর একটা তাগিদ থাকে। কিন্তু সরকারি স্কুলের সেই চাপ নেই। সেখানে মিড ডে মিল আছে। তাই ছাত্র-ছাত্রী আসে। পাস-ফেল নেই, শিক্ষকদের উপর চাপ নেই, তাই পড়ানোটা এবং পড়াশুনা করাটাও নিয়মমাফিক হয়ে থাকে। 

সরকারি স্কুলে কখনো শিক্ষক আসেন, কখনো আসেন না। ছাত্র-ছাত্রীরা কখনো আসে, কখনো আসে না। অথচ পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতে গ্রামেগঞ্জের বিশাল সংখ্যক মানুষের কাছে এখনো একমাত্র ভরসা হলো সরকারি স্কুল। সেই সরকারি স্কুলের বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলের অবস্থা ক্রমশ ভয়াবহ হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকতা করে কিছুদিন আগে অবসর নিয়েছেন দেবাশিস ভৌমিক। তিনি পশ্চিমবঙ্গের একটি গ্রামের স্কুলে পড়াতেন। তার অভিজ্ঞতা হলো, প্রাথমিক স্কুল থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা যখন চতুর্থ শ্রেণিতে আসতো, তখন তাদের অধিকাংশই দু-লাইন বাংলা পড়তে পারতো না। ইংরাজি পড়তে পারার তো প্রশ্নই ওঠে না। ক্লাস এইটে গিয়ে তারা যদি দুই পাতা ভালোভাবে পড়তে পারতো তো সেটা বড় সাফল্য বলে বিবেচনা করা হতো। 

এ তো গেল ছাত্র-ছাত্রীদের কথা। এরপর আসি শিক্ষকদের কথায়। পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রতি একের পর এক নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ সামনে এসেছে। সেখানে আদালতে নিয়োগের সঙ্গে যুক্তরা স্বীকার করে নিয়েছেন, কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে। অযোগ্যদের নিয়োগ পরীক্ষায় নম্বর বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের চাকরি দেয়া হয়েছে। তা এই ধরনের শিক্ষকরা আর যা-ই হোক, ছাত্র-ছাত্রীদের কি ঠিকভাবে পড়াতে পারবেন? এর এককথায় জবাব হলো, না। যারা দুর্নীতির মাধ্যমে শিক্ষকের চাকরি পায়, তাদের আর যাই হোক, শিক্ষকতার পেশার প্রতি কোনো মমত্ববোধ নেই। আর এই বোধ না থাকলে শিক্ষাকে ভালোবেসে, পড়ানোকে পছন্দ করে ছাত্রছাত্রীদের শেখানোর কোনো তাগিদ শিক্ষকদের থাকতে পারে না।

মধ্যপ্রদেশের শিক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, তিনি তার কেন্দ্রের এমন পাঁচশ শিক্ষককে চেনেন, যারা চাকরি পাওয়ার পর সামান্য টাকা দিয়ে লোক রেখেছে।  তারাই স্কুলে গিয়ে তাদের হয়ে পড়ায়। মাসের শেষে না পড়িয়েও অনুপস্থিত শিক্ষকরা মোটা টাকা রোজগার করে।  এই ঘটনা যে শুধু মধ্যপ্রদেশে ঘটছে, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। তাহলে শিক্ষার মান কী করে বাড়বে?

পশ্চিমবঙ্গে তো বামপ্রন্ট সরকার আরেক সর্বনাশ করে দিয়ে গিয়েছিল। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সরকারি স্কুলে ইংরাজি পড়ানো হতো না। সেই সময়ের স্কুল শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন পার্থ দে। তিনি ছিলেন বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজের অধ্যাপক। সেই স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে কোনো পড়ুয়া তির্যকভাবে লিখেছিল, 'বাংলার মাধ্যমে ইংরাজি পড়াতে হবে'। মজা থাক। ঘটনা হলো, পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ পড়ুয়ারা বহুবছর ধরে ইংরাজিতে কাঁচা হয়ে গেল। এখনো তার থেকে বেরনো গেল না।

পশ্চিমবঙ্গে তো মাঝখানে সিভিক ভলান্টিয়ারদের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করার কথা হয়েছিল। আরজি করের ঘটনার পর সিভিক ভলান্টিয়ারদের নিয়ে হইচই হওয়ার পর সেই প্রস্তাব খারিজ হয়েছে। কিন্তু রাজ্যের স্কুলে কলেজে কম পয়সা দিয়ে শিক্ষক-অধ্যাপকদের ঢালাও নিয়োগ করা হচ্ছে।  তাদের নানা রকম নাম। কলেজের ক্ষেত্রে গেস্ট লেকচারার, পার্ট টাইম লেকচারার। স্কুলের ক্ষেত্রে অবস্থা আরো খারাপ। বাম আমলে কিছু অস্থায়ী কর্মী নিয়েগ করা হয়েছিল মাসে ২০ হাজার টাকা বেতনে। তৃণমূলের আমলে তাদের মাইনে সামান্য বাড়িয়ে স্থায়ী করে নেয়া হয়। তারা পড়ান। এদের বেতন সামান্য। অবসর নিলে পেনশন দিতে হয় না।

ভোটে জেতার জন্য লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্বাস্থ্যবিমা, পড়ুয়াদের ল্যাপটপ থেকে শুরু করে হরেক রকম জনমোহিনী প্রকল্পের খরচ জোগাতে নিজের ভাণ্ডার শেষ করে ফেলছে সরকার। ফলে এভাবেই নানা পথ নিতে হচ্ছে। শিক্ষক বা অধ্যাপকরা অবসর নিলে আর শূন্য পদ ভরা হয় না। যারা আছে, তাদের দিয়ে কাজ চালাতে হয়। স্কুলের ক্ষেত্রে শিক্ষকরাই মিড ডে মিলের বিষয়টা দেখে, তারাই গুচ্ছের খাতা দেখেন, বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজ করতে হয়, এখন আবার নম্বর অনলাইনে আপলোড করতে হয়। একটু ভুলচুক হলেই বিপদ।  তাদেরও পড়ার সময় কমে যাচ্ছে।

ফলে মানুষের আস্থা কমছে, আর ব্যাংয়ের ছাতার মতো বেসরকারি স্কুল গজিয়ে উঠছে। সরকারি স্কুলে পড়ানোর জন্য পয়সা দিতে হয় না। বই-খাতাও পাওয়া যায়। বেসরকিরা স্কুলে সব মূল্য ধরে দিতে হয়। ভর্তির সময় মোটা টাকা দিতে হয়। পড়ানোর টাকাও প্রচুর। তা-ও যারা পারে, তারা সরকারি স্কুলের দিকে না তাকিয়ে বেসরকারি স্কুলে চলে যাচ্ছে। তারপরেও ভারতে ১৪ লাখ ৭১ হাজার স্কুলের মধ্যে ১০ লাখ ১৭ হাজার হলো সরকারি স্কুল। ফলে তার মান ভালো না হলে শিক্ষার অবস্থা কী হবে, তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

কিছুদিন আগে মালদহের কাছে গঙ্গার চরে গেছিলাম। সেখানে সরকারি স্কুল আছে। তা সত্ত্বেও সেখানে বেসরকারি স্কুল হয়েছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। তবে নিজের চোখে দেখা বলে 'নেই রাজ্যের' চরে বেসরকারি স্কুলকে আর অবিশ্বাস করতে পারলাম না। মালদহের কাছের আরেকটি চরে ক্লাস সিক্সের এক ছাত্রী আমার চোখ আরো খুলে দিয়েছে। সে জানিয়েছে, স্কুলে তো পড়াশুনা হয় না, তাই সে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ে।

পরিস্থিতি এমনই, কিছু শিখতে গেলে, পাস করতে গেলে প্রাইভেটে পড়তে হবে। না হলে, লবডঙ্কা। আমরা ছোটবেলায় বাবা-মার কাছে পড়েছি। কিন্তু এখন তাদের সময় কোথায়? আর সবার বাচ্চা প্রাইভেটে পড়লে, তো আপনাকেও বাচ্চাদের প্রাইভেটে দিতে হবে। না হলে ভালো নম্বর পাবে না। ভালো নম্বর না পেলে ভালো কলেজ পাওয়া যাবে না। ভালো কলেজ না পেলে...সেই চক্র সমানে চলছে। আর প্রাইভেট টিউটররা সমানে বলতে থাকে, স্কুলে তো পড়াশুনো হয় না। এখানে যাওয়ারই দরকার নেই।অনেক শিক্ষক স্কুলে ঠিক করে পড়ান না। কিন্তু প্রাইভেটে কিঞ্চিত পরিশ্রম করে পড়ান। 

পরিস্থিতিটা খুবই খারাপ। তা-ও যে ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে যায়, তার পিছনে মিড ডে মিল অনেকটা দায়ী। কিন্তু শিখতে হবে, জানতে হবে, আরো পড়তে হবে, সেই বোধটাই তৈরি হচ্ছে না।

১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীন হলো, তখন শিক্ষিতের হার ছিল ১২ শতাংশ। ৭৭-৭৮ বছর পর এখন ভারতে শিক্ষিতের হার প্রায় ৭৮ শতাংশ। তবে এই হার হলো ২০২২ সালের সমীক্ষার ভিত্তিতে। পুরুষদের মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ এবং মেয়েদের মধ্যে ৭০ শতাংশ শিক্ষিত।

নিশ্চিতভাবেই স্বাধীনতার পর শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। কেরালার মতো রাজ্যে প্রায় সব মানুষ শিক্ষিত। প্রচুর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে অন্য কিছু রাজ্যও কেরালার মতো কৃতিত্ব অর্জন করবে। কিন্তু তারপরেও শিক্ষা নিয়ে অনেকগুলি প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। তার মধ্যে প্রথম বিষয় হলো, শিক্ষার মান নিয়ে। এখানে শিক্ষিত বলতে ধরা হয়, যারা পড়তে পারেন, লিখতে পারেন এবং সামান্য অঙ্ক করতে পারেন। ফলে সেই সংখ্যা দেখিয়ে ভারতে শিক্ষার মানের বিষয়টি ধরা যাবে না।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডাব্লিউইএফ) তাদের রিপোর্ট বলছে, শিক্ষার মানের তালিকায় ভারতের স্থান ৯০ তম। এখানে শিক্ষার মানের মাপদণ্ড হলো চিন্তাভাবনা করার, সমালোচনামূলক চিন্তার, সমস্যা সমাধান করার দক্ষতা।

এর সঙ্গে আছে ড্রপ আউটের সমস্যা। রিপোর্ট বলছে, নবম-দশম শ্রেণিতে ১২ দশমিক ছয় শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী পড়া ছেড়ে দেয়। প্রাথমিক স্তরে ৯৫ শতাংশের বেশি ছাত্র-ছাত্রী স্কুলে ভর্তি হয়। তারপর নবম থেকে ১২ ক্লাস পর্যন্ত মাত্র ৪০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী থেকে যায়। বাকিরা কোনো না কোনো ক্লাসে পড়া ছেড়ে দেয়।

কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট বলছে, ১৪ লাখ ৭১ হাজার স্কুলের মধ্যে সাত লাখ ৪৮ হাজার স্কুলে শিক্ষার কাজে কম্পিউটার ব্যবহার করা হয়। ইন্টারনেট আছে সাত লাখ ৯২ হাজার স্কুলে। দুই লাখ ৫৭ হাজার স্কুলে আর্ট ও ক্রাফটের জন্য আলাদা ঘর আছে। ল্যাবরেটরি ছাড়া প্রচুর স্কুল আছে। এখনো দেড় লাখ স্কুলে কোনো ধরনের বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। শৌচালয় বা তার অবস্থার কথা তো আর তুললাম না।

পড়ুয়া নেই সরকারি স্কুলে

২০২৩ সালে সরকারি রিপোর্ট উদ্ধৃত করে এবিপি আনন্দ জানাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে আট হাজার ২০৭টি সরকারি স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা খুবই কমে গেছে। ২২৬টি স্কুলে তো কোনো পড়ুয়াই নেই। স্কুল শিক্ষা দপ্তর অন্য বিভাগকে অনুরোধ করেছে, তারা যেন স্কুলের পরিকাঠামোকে কাজে লাগায়। এই সব স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বিধানসভায় পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেছিলেন, কতগুলি স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে তা খতিয়ে দেখবে সরকার। পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেছিন, সংখ্যাটা জানার পরে তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে বিষয়টি জানাবেন। স্কুলগুলি খোলার চেষ্টা করা হবে। তবে তার এক বছর পরের অবস্থা তো আগেই আপনাদের জানিয়েছি।

সামনে অন্ধকার?

এই অবস্থায় আশার আলো কি দেখা যাচ্ছে? মনে হয় না। যাদের ক্ষমতা আছে, তারা বেসরকারি স্কুলে, বাইরের রাজ্যে, বিদেশে চলে যাচ্ছে। আর যে বিপুল সংখ্যক মানুষের সেই সাধ্য নেই, তাদের ভরসা ওই সরকারি স্কুল। যে স্কুল শুধু অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে তলিয়ে যাচ্ছে অধিকাংশ মানুষের শিক্ষার ভবিষ্যৎ।

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড় ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷