ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্কে আরো মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা
৩ জানুয়ারি ২০২৫আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল(আইএমএফ)-এর চাপে অন্তর্বর্তী সরকার ৬৫টি নিত্যপণ্যের ওপর নতুন করে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়াতে যাচ্ছে। এরমধ্যে ৪৩টি পণ্যে ভ্যাট বাড়ছে। ওই পণ্যগুলোতে বর্তমানে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে ভ্যাট নেয়া হয়। সেক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তা কার্যকর হবে চলতি মাস থেকেই।
এজন্য ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধনী) অধ্যাদেশ ২০২৫-এর খসড়া সংসদ বিষয়ক বিভাগের ভেটিং সাপেক্ষে বুধবার (১ জানুয়ারি) উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তা কার্যকর হলে৬৫ ধরনের পণ্যের ওপর ১৫ থেকে ১০০ শতাংশ ভ্যাট ও শুল্ক বাড়বে।
এলপি গ্যাস, বিস্কুট, আচার, টমেটো কেচাপ,সস, ফলমূল, সাবান, মিষ্টি, ডিটারজেন্ট, চপ্পল (স্যান্ডেল), টিস্যু পেপার, ইন্টারনেট, বিমান টিকিট সিগারেট, বিস্কুট, হোটেল, রেস্তোরাঁ- এসব পণ্য ও সেবা রয়েছে এই তালিকায়।
নেপথ্যে কী?
জানা গেছে, ঋণ দিতে আইএমএফ বাংলাদেশকে কর-জিডিপি অনুপাত ০.২ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে, টাকার অঙ্কে যা ১২ হাজার কোটির বেশি। এই অর্থ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার সঙ্গে যোগ হবে।
জানা গেছে, জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নানাবিধ সংকটে রাজস্ব আদায়ের পরিস্থিতি ভালো নয়। চলতি অর্থ বছরের চার মাসে রাজস্ব ঘাটতি প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এমন অবস্থায় বাড়তি রাজস্ব আদায়ে ভ্যাট বাড়ানোর জন্যই এই পদক্ষেপ।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে দাবি করেছেন," কর বাড়লেও জিনিসপত্রের দামে প্রভাব পড়বে না। আমাদের মূল্যস্ফীতির মূল ওয়েটের ইন্ডিকেটরগুলো হলো-চাল, ডাল এগুলো। আমরা যেসব জিনিসের ওপর কর বাড়াচ্ছি, এগুলো মূল্যস্ফীতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে খুবই কম গুরুত্বপূর্ণ।'' তার কথা, ‘‘পৃথিবীর কোনো দেশেই, এমনকি নেপাল, ভুটানেও বাংলাদেশের মতো এত কম কর (ট্যাক্স) নেই।নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ক্ষেত্রে আমরা সব সময় বলেছি, সেখানে আমরা প্রায় জিরো কর-এ নিয়ে আসব।''
‘অর্থ উপদেষ্টার কথা গ্রহণযোগ্য নয়'
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, " অর্থ উপদেষ্টার কথা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রথমত, অর্থ বছরের মাঝখানে এভাবে পাইকারীভাবে নিত্যপণ্যের ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর নজির নাই। আর যেসব পণ্যে ভ্যাট বাড়ানো হবে তার মধ্যে শুধুমাত্র সিগারেট ছাড়া আর সব নিত্যপণ্য।"
‘‘অর্থ উপদেষ্টা যা-ই বলুক না কেন এমনিতেই মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। নতুন ভ্যাটের ফলে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। সাধারণ মানুষ আরো চাপে পড়বে। অর্থ উপদেষ্টার সান্ত্বনামূলক কথা সাধারণ মানুষের কোনো কাজে আসবে না।”
তার কথা, " এই ভ্যাট তো ব্যবসায়িরা দেবে না। এটার চাপ পড়বে ভোক্তাদের ওপর। তাদের আয় বড়ছে না। কিন্তু খরচ আরো বাড়বে। ফলে তারা ব্যবহার কমিয়ে দিতে বাধ্য হবে, অথবা ঋণগ্রস্ত হবে।”
ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ
সরকারের এই সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ীরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে ওষুধ শিল্প, মোবাইল ফোন অপারেটর, হোটেল ও রস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাদের কথা এই ভ্যাটের ফলে তাদের শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গ্রাহক হারাবেন, বিক্রয় কমবে। ভ্যাটের বাইরেও তাদের আরো ট্যাক্স দিতে হয়। ফলে এখন পণ্যের দাম আরো বেড়ে যাবে। এমনিতেই মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে। আরো দাম বাড়লে তারা কেনা কমিয়ে দেবেন। ফলে ব্যবসায়ী ও ভোক্তা উভয় পক্ষই ক্ষতির মুখে পড়বে।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি ইমরান হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, " সরকার যে এত বড় সিদ্ধান্ত নিলো, কিন্তু আমাদের সাথে কথা বললো না, এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানলো না। মনে হলো, ভ্যাট বাড়িয়ে দিলো। এটা তো হয় না। এখন সাধারণ মানের হোটেলেও একজনকে খেতে ৩০০ টাকা লাগবে- সেটা কতজন খেতে পারবে। এমনিতেই ব্যবসা নেই। আরো ধ্বস নামবে।”
তার কথা, " আমরা তো ভ্যাটের বাইরে আরো ট্যাক্স দিই। তারপর ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছেই। আমরা ম্যানেজ করবো কিভাবে। সরকারের এটা ভাবা উচিত ছিল। আমরা সরকারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি। সংবাদ সম্মেলন করবো। তারপরও না হলে আমরা ধর্মঘটে যাওয়ার চিন্তা করছি। এভাবে চলে না,” বলেন তিনি।
‘সরকার আসল জায়গায় হাত দিচ্ছে না'
দেশে মূল্যস্ফীতি এখন চরম পর্যায়ে রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, গত নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১৩.৮০ শতাংশে ঠেকেছে। এটি গত ১৩ বছরের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হার। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪.১০ শতাংশে উঠেছিল। নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার পাশাপাশি সার্বিক মূল্যস্ফীতিও বেড়ে ১১.৩৮ শতাংশে উঠেছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে ১০০ টাকায় যে পণ্য ও সেবা কেনা গেছে, গত বছরের নভেম্বরে একই পরিমাণ পণ্য ও সেবা কিনতে ভোক্তাকে ১১১ টাকা ৩৮ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। ডিসসেম্বরের মূল্যস্ফীতির হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলাম বলেন," অর্থ উপদেষ্টা যা-ই বলুন না কেন অর্থনীতির সূত্র তো আর উল্টে যাবে না। সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে এবং এর চাপ পড়বে ভোক্তাদের উপর।”
তার কথা, " গত ছয় মাসে রাজস্ব আদায়ের যে গতি, তা আশাব্যঞ্জক নয়। কিন্তু সরকারের তো রাজস্ব দরকার। সেই কারণেই নতুন করে ভ্যাট-ট্যাক্স বসাচ্ছে। তবে এতে জনমনে অসন্তোষ বাড়বে। কিন্তু এটা না করে এএনবিআরের এনফোর্সমেন্টে যে সমস্যা আছে, সেটা দূর করতে পারতো। ট্যাক্স আদায়ে দুর্বলতা কমালে আদায় বাড়তো। আবার অনেকেই ট্যাক্স নেটের আওতায় নেই, যারা ট্যাক্স দেয়ার যোগ্য। তাদের করের আওতায় আনতে পারলেও ট্যাক্স আদায় বাড়তো।”
অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের পরিচালক ড. মাহফুজ কবির বলেন, "২০২৩ সালের জুলাই থেকে নভেম্বরের তুলনায় ২০২৪ সালের একই সময়ে পাঁচ মাসে ২.৬২ শতাংশ রাজস্ব আয় কম হয়েছে। আর নভেম্বরেই কমেছে ৯ শতাংশ। ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, ভোক্তা পর্যায়ে মুসক(ভ্যাট), কর্পোরেট খাত- সবখানেই কর আদায় কমে গেছে। এর মানে হলো, বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে, আয় কমে যাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য কমছে। ফলে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে রাজস্ব খাতে আয় আরো কমবে ।”
তার কথা, " আসলে এখন এইভাবে ভ্যাট আরোপ করলে মানুষের কষ্ট বাড়বে। আবার ইনকাম ট্যাক্সও এখন বাড়ানো যাবে বলে মনে হয়না। উপায় হলো বিনিয়োগ বাড়ানো। তার জন্য ব্যাংক সুদের হার কমাতে হবে আর এনবিআরে দুর্নীতি কমাতে হবে। এটার উপায় হলো, ট্যাক্স সিস্টেমকে অটোমেশন করা। সেটা করা হলে ট্যাক্স আদায় বেড়ে যাবে। ট্যাক্স নেটও বাড়ানো যাবে।”
"যেসব পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে, সেগুলো আসলে নিত্যপণ্য ও সেবা। এর ফলে সাধারণ মানুষ চাপে পড়বে। কারণ, তাদের আয় বাড়ছে না,” বলেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে এসএম নাজের হোসাইন বলেন, " আইএমএফ-এর চাপে সরকার রাজস্ব বাড়াতে এটা করছে। কিন্তু যে ২০-৩০ শতাংশ কর ফাঁকির ঘটনা ঘটে, সেটা বন্ধে এনবিআর কোনো উদ্যোগ নেয় না। কর্পোরেট ট্যাক্স, ইনকাম ট্যাক্স নেট বাড়ানো হচ্ছে না। এনবিআরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা ট্যাক্স ফাঁকি দিতে সহায়তা করে। ৫ আগস্টের পরেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে ভ্যাট বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের গলাকাটার পথ তৈরি করা হলো। এনবিআরের অনেক কর্মকর্তাই কর্পোরেটদের এজেন্ট। তাদের কাজ হলো, কার্পোরেটরা কীভাবে কর ফাঁকি দিতে পারে, তার ব্যবস্থা করা।”