1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘মব জাস্টিস‘ : যা না থামালে বর্বরতা বাড়বে

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

‘মব জাস্টিস', অর্থাৎ এক দল লোকের জোর করে নিজের হাতে বিচার তুলে নেয়ার ঘটনা বাংলাদেশে চরম উদ্বেগজনক অস্থায় পৌঁছেছে৷

https://p.dw.com/p/4kcoB
সচিবালয়ের সামনে আনসারদের বিক্ষোভ
শিক্ষার্থীদের একটি অংশ সচিবালয় অবরোধ করে পরীক্ষা বাতিল করিয়ে নিলেও আনসার বিক্ষোভ দমন করা হয়েছে ছাত্রদের সহায়তায়ছবি: Habibur Rahman

অন্তর্বর্তী সরকারের স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসও বুধবার জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন৷

এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়কও তথাকথিত ‘মব জাস্টিসের' বিরুদ্ধে তাদের শক্ত অবস্থানের কথা জানিয়েছেন৷ কিন্তু এসবে কোনো কাজ হচ্ছে না৷

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বড় আকারে ‘মব জাস্টিস' শুরু হয়৷ তবে বাংলাদেশে এই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা আগেও দেখা গেছে৷ তবে সেটা ছিল কথিত চোর-ডাকাতকে গণপিটুনি দেয়ার ঘটনা৷ কিন্তু এবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা কর্মকর্তাদের জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা, মারপিট করে তাড়িয়ে দেয়, আদালত এলাকায় আসামিদের ওপর হামলা, কোথাও কোথাও পিটিয়ে, কুপিয়ে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে৷ কিন্তু কোনো ঘটনায়ই জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করা বা আইনের আওতায় আনার মতো খবর এখনো পাওয়া যায়নি৷ প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টাদের হুঁশিয়ারি এবং ‘মব জাস্টিস' দুই-ই চলছে

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করাও বিভিন্ন জেলা সফর করতে গিয়ে কোথাও কোথাও তারা প্রতিরোধ ও বিক্ষোভের মুখে পড়ছেন৷ সর্বশেষ বগুড়ায় তারা সমাবেশ করতে গিয়ে পুলিশ ও সেনা পাহারায় সমাবেশ না করেই ফিরে আসতে বাধ্য হন৷ এরকম ঘটনা আরো কয়েকটি জেলা থেকে এসেছে৷

ইউটিউবার হিরো আলম ২০২৩ সালের ১৭ জুলাই ঢাকা-১৭ আসনের উপ নির্বাচনের সময় হামলার শিকার হয়েছিলেন৷ তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাতের বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছিলেন৷ আরাফাতের দল আওয়ামী লীগের সরকারের পতন হয়েছে৷ কিন্তু হিরো আলমের ওপর হামলা থামেনি৷ গত ৮ সেপ্টেম্বর বগুড়ায় আদালত চত্বরে হামলার শিকার হয়েছেন আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম৷ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ এনে কয়েকজন যুবক এই হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন হিরো আলম৷ হামলার প্রতিক্রিয়ায় হিরো আলম বলেন, "এক স্বৈরাচারের পতনের পর আরেক দল নিজেদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শুরু করেছে৷”

একই দিনে রাজশাহীতে পিটিয়ে হত্যা করা হয় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, পঙ্গু আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে৷ আট বছর আগে আরেক হামলায় তিনি একটি পা হারান৷ তারপর থেকে তিনি প্লাস্টিকের পা লাগিয়ে চলাফেরা করতেন৷ সেদিন তিনি ওষুধ কিনতে বের হয়েছিলেন৷ ৫ আগস্ট ছাত্রদের ওপর হামলার অভিযোগ তুলে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ ৩ সেপ্টেস্বর তিনি এক কন্যা সন্তানের জনক হয়েছিলেন৷

অন্তর্ববর্তী সরকার গঠিত হয় ৮ আগস্ট৷ এরপর শুরু হয় মামলা৷ এইসব মামলায় বাছ বিচার না করে গণহারে আসামি করা হচ্ছে৷ আর পতিত সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা আটক হতে শুরু করার পর আদালত এলাকায় পুলিশের  উপাস্থিতিতেই তাদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে৷ তাদের পিটিয়ে রক্তাক্তও করা হয়৷ এই হামলা থেকে নারীরাও রেহাই পাননি৷

অন্তর্বর্তী সরকার এই বিষয়ে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে না: অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, "৫ আগস্টের পর থেকে যেসব ঘটনা ঘটছে তা আমার অ্যালার্মিং মনে হচ্ছে৷ এই ধরনের ঘটনা আমরা প্রত্যাশা করি নাই৷ পিটিয়ে মারা, পাগল বলে পিটিয়ে মারা- এগুলোতে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে গেছি৷ জুলাই মাসে শুরু হওয়া এই ধরনের নারকীয় হত্যা, হামলা এখনো চলছে৷ এগুলো তো আমাদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে৷  সাপ মারার মতো মানুষ পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে৷ এগুলো যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে তো আইনের শাসন বলে কিছু থাকেনা৷ ”

"আপনি কোন আইনে শিক্ষকদের ওপর হামলা চালাচ্ছেন? তাদের পদত্যাগে বাধ্য করছেন৷ বিভিন্ন দপ্তরে গিয়ে পদত্যাগ করাচ্ছেন৷ যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবে৷ কিন্তু এগুলো যারা করছে, তারা কীভাবে করছে৷ যারা করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না কেন?”

তিনি বলেন, "কয়েকদিন আগে সাত রাস্তার মোড় বন্ধ করে ছাত্ররা আন্দোলন করলো৷ তারা রাস্তা দখল করলো৷ আমাদের গাড়িগুলো আটকে গেল৷ ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে গল্প করছিল৷ কেউ কোনো দায়িত্ব পালন করছে না, যে যার মতো চলছে৷”

বাংলাদেশে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখানো ক্লাস শুরু হয়নি৷ ৫০টির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসিকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে৷ দুই শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে জোর করে সরিয়ে দেয়া হয়েছে৷ শিক্ষকদের ওপর হামলাও হয়েছে৷ হামলা হয়েছে সংখ্যালঘুদের ওপর৷
বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে হামলা ও আগুনের ঘটনা পরিস্থিতি ভয়াবহ করে তুলেছে৷ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী টায়ার নামের শিল্প প্রতিষ্ঠানটি রীতিমতো ‘উৎসব করে' ধ্বংস করা হয়েছে৷

এখন চলছে মাজার ভাঙার মতো নাশকতা৷ নারায়াণঞ্জের দেওয়ানবাগীর মাজারসহ আরো কয়েকটি মাজার ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে৷ ঢাকার গোলাপ শাহ মাজারে চলছে আতঙ্ক৷ সেটাও ভেঙে দেয়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, "দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মধ্যে হতাশা ও বিচারহীনতার কারণে এই ‘মব জাস্টিস' চলছে৷ কিন্তু এখানে আমি দায়িত্বহীনতাও দেখতে পাই৷ এখন যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, তারাও এই বিষয়ে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে না৷ এই যে ছাত্ররা গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছে৷ কোথাও কোথাও তাদের সংশ্লিষ্টতায়৷ আবার কোথাও কোথাও অতি উৎসাহী জনতার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে৷”

"আমার আশঙ্কা হচ্ছে, এই পরিস্থিতির কারণে এত বড় একটা অর্জন নষ্ট না হয়ে যায়৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন ভয়াবহ অবস্থা৷ বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন নিয়ন্ত্রনহীন৷ কোনো শিক্ষক, পুলিশ বা কোনো সরকারি কর্মকর্তা যদি কোনো অন্যায় করে থাকেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যায়৷ কিন্তু এখন তো বেআইনি কাজ হচ্ছে,'' বলেন এই অধ্যাপক৷

তার কথা, "এই যে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন হলো, এটা একটা গণঅভ্যুত্থান৷ এটাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিপ্লব মনে করি না৷ আমাদের কালচারাল বিপ্লব প্রয়োজন৷ আমরা যদি ফরাসী বিপ্লব, রুশ বিপ্লব দেখি তাহলে বিষয়গুলো স্পষ্ট হবে৷ এখন এই অন্তর্বর্তী সরকার যদি দ্রুত এইসব মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয় তাহলে ম্যাসাকার হয়ে যাবে৷”

বাংলাদেশের থানাগুলোতে হামলা ও অস্ত্র লুটের ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে৷ লুটের অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি৷ আতঙ্কে অনেক পুলিশ সদস্য এখনো কাজে যোগ দেননি৷

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধান ও সাবেক ডিআইজি সৈয়দ বজলুল করিম বলেন, "এখন আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার যে ভয়ঙ্কর প্রবণতা চলছে, তা কোনো সভ্য সমাজে চলতে পারে না৷ অধ্যাপক ইউনূসের মতো একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন৷ তার সরকারের উচিত হবে এই সব মব জাস্টিসের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া৷ ”

৫ আগস্টের পর থেকে যেসব ঘটনা ঘটছে তা আমার অ্যালার্মিং মনে হচ্ছে: ব্যারিস্টার ওমর ফারুক

তার কথা, "গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি সরকারের পতন হয়েছে৷ এখন কিছু লোক মনে করছেন, তারা যা খুশি তা-ই করতে পারবেন৷ আবার কোনো একটি গ্রুপ হয়তো পরিস্থিতি খারাপ করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চাইবে৷ কেউ কেউ আবার সুযোগ নিচ্ছেন৷ ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷ পুলিশের ওপর ব্যাপক হামলার পর পুলিশও এখন আর তেমন সক্রিয় না৷ সরকারের উচিত হবে সেনাবাহিনীকে আরো অ্যাকটিভ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা৷”

জেলা প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে৷ যারা জেলা প্রশাসক হতে চান, কিন্তু পারেননি, তারা প্রতিদিনই সচিবালয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছেন৷ এর আগে ছাত্ররা সচিবালয়ে ঢুকে উপদেষ্টাদের ঘেরাও করে এইএইচসি পরীক্ষার অবশিষ্ট ছয় বিষয়ের পরীক্ষা বাতিল করিয়ে নিয়েছে৷ তাদের দেখে আনসার সদস্যরাও সচিবালয়ে ঢুকে দাবি আদায়ের জন্য জিম্মি অবস্থার সৃষ্টি করেছিল৷ তাদের অবশ্য দমন করা হয়েছে ছাত্রদের সহায়তায়৷

সমাজ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড, নেহাল করিম বলেন, "বাংলাদেশে শতকরা ৯৯ ভাগ লোকের সামাজিকীকরণ ঠিকমতো হয়নি৷ ফলে সব পেশাতেই অসামঞ্জস্য আছে, বৈষম্য আছে৷ ফলে আগামী চার-পাঁচ মাসে বিভিন্ন সেক্টরে আরো বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা আছে৷ কারণ, এখন যে পারছে, সে-ই নিজের মতো করে ব্যবস্থা নিতে চাইছে৷ ”

"এই ছাত্রদের অনেক বেশি প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে৷ তাদের উপদেষ্টা করা হয়েছে৷ তাদের সহ-উপদেষ্টা করা যেতো৷ কিন্তু উপদেষ্টা বা সচিব করা ঠিক হয়নি৷ আর এরা দেখেছে, তারা বিক্ষোভ করলে আইন বদলায়, তারা কিছু দাবি করলে তা মেনে নেয়া হয়, এটা সমাজের সর্বস্তরে সঞ্চারিত হচ্ছে৷ ফলে সবাই একইভাবে চাইছে সব আদায় করে নিতে৷ এখন তাদের কাউকে পছন্দ না হলেই তাকে টেনে নামাচ্ছে৷ হামলা করছে৷ সেটা পুলিশ, প্রশাসন, শিক্ষক সব শ্রেণিই এর শিকার হচ্ছেন৷ ”

তার কথা, "এদের এখনই থামিয়ে দিতে হবে৷ নয়তো বর্বরতা আরো বাড়বে৷”