1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নতুন বাস্তবতায় বিজয় দিবস

ডয়চে ভেলের অতিথি লেখক মাসুদ কামাল৷
মাসুদ কামাল
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪

গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর বিজয় দিবসটা ঠিক কীভাবে উদ্‌যাপন করে ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, তা নিয়ে আমার বেশ কৌতূহল ছিল।

https://p.dw.com/p/4o5lV
ছবিতে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে বিজয় দিবস উদযাপন৷
দেশের নাগরিক উদযাপন করেন বিজয় দিবস। ভাগাভাগি করেন বিজয়ের আনন্দ। ছবি: MOHAMMAD PONIR HOSSAIN/REUTERS

বিজয় দিবসের চার দিন আগে, ১২ ডিসেম্বর, দেখলাম সরকার ১৪ ও ১৬ ডিসেম্বর উদ্‌যাপনের একটা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় স্মৃতি সৌধে যাওয়া, প্রথম প্রহরে তোপধ্বনি, ইত্যাদি সকল কর্মসূচিই রয়েছে।

ঘোষিত সেইসব কর্মসূচির দিকে তাকালে আগের বছরগুলোর সঙ্গে বিশাল কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। কাগজে-কলমে একই রকম থাকলেও আসলেই কি এবারের বিজয় দিবস উদযাপনে আগের তুলনায় কোনোই পার্থক্য থাকবে না? থাকবে, নিশ্চয়ই থাকবে। এটা গ্যারান্টি দিয়েই বলা যায়।

আসলে বাস্তবতাই পাল্টে গেছে। সরকার পাল্টে গেছে, শীর্ষ ব্যক্তিসহ সরকারের লোকগুলো পাল্টে গেছে। পাল্টে গেছে তাদের রাজনীতি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবশ্য নিজেদেরকে নির্দলীয় বলেই দাবি করেন। কিন্তু এই দাবির মধ্যেও বিশাল এক রাজনীতি আছে। নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় বলা যাবে তাদেরকেই, যারা যে কোনো বিবেচনায় সকল দলের প্রতিই একই ধরনের আচরণ করবেন। এরা কি তাই করছে? কোনো ধরনের বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্যে না গিয়েই এরা কিছু কিছু দলকে, দলের আদর্শকে সরাসরি ‘গণবিরোধী' হিসাবে অভিহিত করছে। ব্যক্তির দায় চাপিয়ে দিচ্ছে পুরো দলের ওপর। এমন আচরণকে আর যা-ই বলা যাক, নিরপেক্ষ বলা যাবে না।

৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের মাধ্যমে ড. ইউনূসের নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এরই মধ্যে তারা নিজেদের চরিত্রের পরিচয় বেশ ভালোভাবেই দেশের মানুষের কাছে প্রকাশ করতে পেরেছে। ইতোমধ্যে তারা ৭মার্চ-সহ বেশ কয়েকটি জাতীয় দিবসকে বাতিল ঘোষণা করেছে। বাতিল হওয়া দিবসগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি যে আগের সরকার একেবারে রাজনৈতিক বিবেচনাতেই গ্রহণ করেছিল, সেটা বুঝতে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু তারা যখন ঐতিহাসিক ৭ মার্চকে সেই সব বিতর্কিত দিবসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে, তখন এদের রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা যদি ধরি, সেখানে আওয়ামী লীগ ছাড়াও অন্য অনেক দলের লোক ছিল। কোনো রাজনৈতিক দলই করে না—এমন মানুষও ছিল। রাজনৈতিক মতভেদ থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেমন তাদের মধ্যে কোনোই বিরোধ ছিল না, তেমনি কোনো দ্বিমত ছিল না ৭মার্চ-এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এই দিনটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পর্যন্ত দিবসটির গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এমন একটা দিবসকে এই সরকার অবলীলায় জাতীয় দিবসের তালিকা থেকে বাতিল করে দিয়েছে।

অনেকেই ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সেই ভাষণকে আমাদের স্বাধীনতার প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করেন। তারা বলেন, ওই ভাষণের মাধ্যমে ওই দিনই আসলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার অপরিহার্যতার বিষয়টি প্রকাশ করে দিয়েছিলেন। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের রণকৌশল কেমন হবে, সে বিষয়গুলোও বলে দিয়েছিলেন। বিপরীত দিকে কেউ কেউ আবার ৭ মার্চের ভাষণকে অতটা গুরুত্ব দিতে রাজি হন না। তাদের কাছে সেটি ছিল নিছকই একটা রাজনৈতিক সমাবেশের ভাষণ। আওয়ামী লীগের সেই সময়কার সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান সকল সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সেদিন তার ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে তিনি আসলে সেদিনের জনসভায় উপস্থিত লাখো মানুষের প্রত্যাশাকে হতাশায় পরিণত করেছিলেন। দেশের আজকের সরকার এই দ্বিতীয় মতটিকে কেবল সমর্থনই করে না, সেই সঙ্গে একে প্রতিষ্ঠিতও করতে চায়। 

এই সরকার ৭মার্চ মানে না, বঙ্গবন্ধু মানে না, শেখ মুজিবকে জাতির পিতা হিসাবেও মানে না। অথচ লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই শেষের বিষয়টি, অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জাতির পিতা হিসাবে স্বীকৃতি কিন্তু আমাদের সংবিধানেই দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি প্রতিটি সরকারি অফিসে টাঙানোর কথা। দেশে এরই মধ্যে সংবিধান সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। তারা সংবিধানের সংস্কার বা পুনর্লিখন নিয়ে নানা গবেষণাও করছেন। সেই কমিশনের রিপোর্ট পাওয়ার পর নানা আলোচনা, আরো গবেষণা, মত বিনিময়, ইত্যাদির পর হয়ত জাতি একটা নতুন সংবিধান পাবে। কিন্তু নতুন সংবিধান না আসা পর্যন্ত পুরানো সংবিধানকে অমান্য করা কি প্রশংসনীয় কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে? অথবা কোনো বাহাদুরির কাজ? অথচ এই সরকারের অন্তত দুজন উপদেষ্টাকে দেখা গেছে প্রকাশ্যে সে কাজগুলো করতে। একজন তো বঙ্গভবনে সংবিধানের আলোকে শপথ নিয়ে, শপথে সংবিধান সমুন্নত রাখার কথা উচ্চারণ করে, দশ মিনিটের মধ্যেই বঙ্গভবনের দেয়ালে থাকা বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে ফেলার মাধ্যমে সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। কেবল তাই নয়, সচিবালয়েও সকল উপদেষ্টার অফিসকক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের এমন আচরণের প্রভাব পড়েছে প্রশাসনের সর্বত্র। রাজধানী থেকে শুরু করে জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে পর্যন্ত এই হুজুগ কার্যকর হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের কাছে সংবিধান মান্য করার চেয়ে উপদেষ্টাদের অনুকরণে অমান্য করাই বেশি নিরাপদ বলে বিবেচিত হয়েছে।

একাত্তরের কণ্ঠসৈনিক শাহীন সামাদ

এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাগণ অদ্ভুত এক যুক্তি দিয়ে থাকেন। তারা বলেন—এটা বিপ্লবী সরকার। তাই এরা সব নিয়ম মানবে না। নিয়ম ভেঙেই তারা আন্দোলন করেছে, সরকারের পতন ঘটিয়েছে। সংবিধান মেনে চললে কি আর আন্দোলন করা যেতো? সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদায়ও সংবিধান মেনে হয়নি। কাজেই এই সরকার যেভাবে কাজ করবে, যেভাবে কাজ করাটাকে ভালো মনে করবে, সেটাকেই আইন বলে মানতে হবে। এসব যুক্তি যখন উচ্চারিত হয়, তখন পাল্টা প্রশ্ন উঠতেই পারে—তাহলে আপনারা সরকার গঠন কেন সংবিধান অনুযায়ী করলেন, শপথের সময় কেন সংবিধান সমুন্নত রাখার কথা বললেন?

বললাম বটে এসব প্রশ্ন উঠতেই পারে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে—এসব প্রশ্ন উঠবে না। উঠবে না এ কারণে যে, মনে মনে যা-ই থাক এই সরকারকে প্রকাশ্যে কেউই আসলে কোনো প্রকার চ্যালেঞ্জ করছে না।কোনো প্রকার ভয়ে নয়, আসলে প্রায় সকলেই এই সরকারকে অনেকটা প্রশ্রয়ই দিতে চায়। তারা মনে করে, রক্তক্ষয়ী একটা আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী একটা সরকারকে হটানো গেছে, নতুন একটা সরকারকে বসানো হয়েছে, এরা যেন কোনোভাবেই ব্যর্থ না হয়। দেশের মানুষ আসলে নতুন একটা নির্বাচনের আগে পর্যন্ত এই সরকারকে টিকিয়ে রাখতে চায়। এই সরকার ব্যর্থ হলে,গণ-আন্দোলনের যথার্থতা নিয়েই হয়ত প্রশ্ন উঠবে। অথচ গণতন্ত্রের জন্য জনগণের যে প্রবল আকাঙ্ক্ষা, সেটাই হয়ত মার খেয়ে যাবে। একটা প্রশ্ন ইদানীং প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে, সেটা হচ্ছে—এই যে প্রবল প্রশ্রয় জনগণের, সরকার কি সেটা ধারণ করতে পারছে?

মূল লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক সৃষ্টির যে প্রবণতা সরকারের মধ্যে প্রায়ই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে, সে কারণেই হয়ত আসন্ন ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালন নিয়ে মানুষের মনে কিছুটা হলেও কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। তবে একটা কথা কিন্তু স্বীকার করতেই হবে, আগের হাসিনা সরকারের আমলে এইরকম বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন নিয়ে বিভিন্ন মহলের যে বাড়াবাড়ি, সে সব এবার দেখা যাচ্ছে না। গত ১৫ বছর ধরেই ডিসেম্বরের প্রথম দিন থেকে প্রতিটি টেলিভিশনে ‘বিজয়ের মাস' পালনের বাধ্যবাধকতা থাকতো। কেবল টেলিভিশনই নয়, প্রতিটি মিডিয়াতেই এসব আনুষ্ঠানিকতার জন্য সরকারি নির্দেশনা থাকতো। একটা ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, মোসাহেবির বাড়াবাড়ির কারণে এইসব আনুষ্ঠানিকতা শেষ পর্যন্ত কিন্তু মুজিব বন্দনায় পরিণত হয়ে যেতো। কেবল বিজয় দিবসই নয়, জাতীয় পর্যায়ে পালিত সকল দিবসই আসলে ঘুরেফিরে প্রধানমন্ত্রীর তোষণ ও তার পিতার বন্দনায় রূপান্তরিত হতো। আসন্ন বিজয় দিবসের প্রকৃত চেহারাটা শেষ পর্যন্ত কেমন দাঁড়াবে, সেটা নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকলেও, আগের বছরগুলোর সেই ‘পিতা-বন্দনা' জাতীয় কিছু হবে না, সেটা বলা যায় নির্দ্বিধায়।