মেদিনীপুরে সরকারি হাসপাতালে স্যালাইনকাণ্ড, এক প্রসূতির মৃত্যু, সংকটজনক তিনজন
পশ্চিম মেদিনীপুরে সরকারি হাসপাতালে একজন প্রসূতির মৃত্যু, তিনজনের অবস্থা গুরুতর। অভিযোগ, বিষাক্ত স্যালাইন দেয়ায় এই কাণ্ড হয়েছে।
প্রসূতি-মৃত্যুর কারণ বিষাক্ত স্যালাইন?
মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালে বিষাক্ত স্যালাইনের কারণে প্রসূতি-মৃত্যুর অভিযোগ। একই দিনে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। সন্তান জন্মের পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন পাঁচ প্রসূতি। শুক্রবার তাঁদের এক জনের মৃত্যু হয়। মৃত মামণির পরিবারের অভিযোগ, বিষাক্ত স্যালাইন দেয়াতেই তার মৃত্যু হয়েছে। এই স্যালাইনগুলির ঠিক থাকার তারিখও পেরিয়ে গেছিল বলে অভিযোগ।
এবারই প্রথম নয়
গত নভেম্বরে পরপর প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনার পর কর্নাটক সরকার ব্ল্যাকলিস্ট করে আরএল স্যালাইনের প্রস্তুতকারক পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যালসকে। গত ১০ ডিসেম্বর গুণমানের প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যালসের স্যালাইন উৎপাদনকে নিষিদ্ধ করে রাজ্য। সেই স্যালাইনই দেয়ার অভিযোগ পাঁচ প্রসূতিকে। এই ঘটনার পর মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রোগীর পরিজনেরা বিক্ষোভ দেখান। বিক্ষোভ দেখায় সিপিএমের যুব সংগঠনের সদস্যরাও।
স্বাস্থ্য দপ্তরের নির্দেশ
অভিযোগ, প্রায় আট মাস আগে স্বাস্থ্য দপ্তরের নির্দেশে সরিয়ে রাখা স্যালাইন (রিঙ্গার্স ল্যাকটেট) ব্যবহার করা হয়েছিল। সেই স্যালাইন যে ওই হাসপাতালে মজুত ছিল, তেমনটাও নয়। বরং তা নিয়ে আসা হয়েছিল পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরের রিজ়ার্ভ স্টোর (ডিআরএস) থেকে। এক প্রসূতির মৃত্যু এবং আরও তিনজনের শারীরিক অবস্থা সঙ্কটজনক হওয়ার পর ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে এমনই তথ্য উঠে এসেছে স্বাস্থ্য ভবনের হাতে।
পুলিশ মোতায়েন
সূত্রের খবর, গত বছরের এপ্রিল থেকেই রাজ্যের কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজ থেকে প্রসূতি-মৃত্যু ও তাদের অবস্থা সঙ্কটজনক হওয়ার খবর আসতে থাকে। ঘটনায় ওই বিশেষ স্যালাইন ব্যবহারকেই দায়ী করতে থাকেন চিকিৎসকেরা। পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হওয়ায় গত বছরের জুন নাগাদ স্বাস্থ্য দপ্তর বিষয়টি বিশদে খতিয়ে দেখতে শুরু করে। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ঘটনার পর সেখানে পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়।
নির্দেশ মানা হয়নি
বুধবার অস্ত্রোপচারের পরে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের পাঁচ প্রসূতিকে যে ‘রিঙ্গার্স ল্যাকটেট’ দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল রিপোর্ট না-আসা সেই ‘২৩৯৬’ ব্যাচ নম্বরের স্যালাইন। যা সরিয়ে রাখার নির্দেশ ছিল। ওই স্যালাইন দেয়ার পরে পাঁচ জন অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং শুক্রবার সকালে মামণি রুইদাসের মৃত্যু হয়। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ মৌসুমী নন্দী জানান তদন্ত চলছে। ঘটনার কারণ নিয়ে তিনি মন্তব্য করতে পারবেন না।
কলকাতায় আনা হলো
যে তিনজনের শারীরিক পরিস্থিতি সংকটজনক, তাদের কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছে। রোববার গ্রিন করিডোর তৈরি করে তিনটি আলাদা অ্যাম্বুলেন্স করে তাদের কলকাতায় নিয়ে আসা হয়।
ঘটনাস্থলে তদন্তকারীরা
স্বাস্থ্যভবন সূত্রে খবর, শনিবার মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ পরিদর্শন করেন স্বাস্থ্যদপ্তরের ১৩ তদন্তকারী কর্মকর্তা। কলেজের সুপার ও অধ্যক্ষের সঙ্গে তাদের দীর্ঘ বৈঠক হয়। তার ভিত্তিতে তৈরি হচ্ছে রিপোর্ট। রোববারের মধ্যে তা নবান্নে জমা দেয়া হতে পারে। তারপর তা খতিয়ে দেখবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
নিষেধাজ্ঞা জারি থাকছে
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে স্বাস্থ্যাসচিবের কাছে রিপোর্ট তলব করেছে মুখ্যসচিব। স্বাস্থ্যভবনের তরফে নির্দেশিকা জারি করে রাজ্যের সমস্ত সরকারি মেডিক্যাল কলেজকে পাঠানো হয়েছে। বলা হচ্ছে, যে সংস্থার তৈরি স্যালাইন নিয়ে এত বিতর্ক, তাদের তৈরি অন্যান্য স্যালাইনও আপাতত নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। সেগুলির নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণাগারে পাঠানো হবে। পরীক্ষার ফলাফল হাতে না পাওয়া পর্যন্ত তা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি থাকছে।
মৃতের পরিজনের প্রশ্ন
মৃত মামনি রুইদাসের পরিবার প্রশ্ন তুলছে, এখন এত সচেতনতা দেখিয়ে কী লাভ? একটা প্রাণ চলে গেলো! কিন্তু ঘটনা হলো, রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে এমন নিষিদ্ধ ওষুধ ব্যবহার সম্পূর্ণ রুখতে আগেই কয়েকটি সংস্থাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। তাদের তৈরি ওষুধ বা অন্য কোনওরকম মেডিক্যাল সরঞ্জাম ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
দুর্নীতি দেখছেন অনিকেত
আরজি কর আন্দোলনের নেতা অনিকেত মাহাতো ডিডাব্লিউকে বলেন, ''ব্ল্যাকলিস্টেড হওয়ার পরেও তা ব্যবহার করা হচ্ছে। এর থেকেই স্পষ্ট পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেহাল অবস্থা। আমাদের আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নতি। মানুষের মৃত্যুর পরেও সরকারের টনক নড়েনি, এটা গাফিলতি নয়, খুঁজে দেখলে দুর্নীতিও পাওয়া যাবে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এইসব সমূলে বিনাশ করা যায়, কিন্তু সদিচ্ছার অভাব স্পষ্ট।''
জাল ওষুধ নিয়ে প্রশ্ন
শনিবার সকাল থেকেই কলেজ চত্বরে বিক্ষোভ দেখায় সিপিএমের ছাত্র-যুব সংগঠন এবং কংগ্রেস। উল্লেখ্য, বছরের শুরুতেই কলকাতায় জাল জীবনদায়ী ওষুধের চক্রের পর্দাফাঁস হয়েছিল। উদ্ধার হয় প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকার জাল ওষুধ। যে গোডাউনে হানা গিয়ে জাল ওষুধগুলি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল, তার কয়েকশো মিটারের মধ্যেই রয়েছে একাধিক ওষুধের দোকান। তারা জানান, এমন কারবারের কথা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তারা।
বিজেপি নেতার বক্তব্য
জাল ওষুধ প্রসঙ্গে বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ বলেন, “ভেজাল স্যালাইন, ভেজাল ইঞ্জেকশান, এমনকি সিরিঞ্জ ধুয়ে ব্যবহারের খবরও এসেছে। এই সব এই রাজ্যে নিয়মিত চলছে। নতুন কিছু নয়। ধরা পড়লে জানতে পারি।''
হাইকোর্টে মামলা
কলকাতা হাইকোর্টে বিষাক্ত স্যালাইনকাণ্ড নিয়ে দুইটি মামলা করতে চান আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি এবং কৌস্তুভ বাগচী। প্রধান বিচারপতি শিবজ্ঞানমের বেঞ্চ দুইটি মামলা দায়ের করার অনুমতি দিয়েছেন। আগামী বৃহস্পতিবার মামলার শুনানি হতে পারে।