‘রাষ্ট্রের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, বিদেশি সহায়তায় হবে না’
১০ জানুয়ারি ২০২৫ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। এখানকার শিক্ষার মান ভলো নয় বলে নানা সূচকে প্রকাশ পাচ্ছে। এর কারণ কী?
ড. সামিনা লুৎফা: অনেকগুলো কারণ আছে। তার মধ্যে প্রথম হলো অবকাঠামো। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এক ধরনের সরকারি ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আছে, যা নিয়োগ থেকে শুরু করে শিক্ষার্র্থীদের জীবনমান থেকে সবকিছুকে প্রভাবিত করে। শিক্ষক যদি মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ না হয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় হয়, তাহলে শিক্ষার মান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। আপনি যখন শিক্ষক নিয়োগ থেকে পদোন্নতি সব কিছু রাজনৈতিক বিবেচনায় করবেন, তখন কিন্তু গুণগত মানসম্পন্ন গবেষণার প্রয়োজন হবে না, শিক্ষার্থীদের ক্লাসে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না এবং স্বায়ত্তশাসনের অপব্যবহারের প্রবণতা তৈরি হবে। বিশেষ করে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে পরিচালিত হয়।
শিক্ষার মান নির্ধারণের জন্য আসলে কি কোনো পদ্ধতি আছে? থাকলে সেটা কী?
না, আসলে ইউনিফায়েড কোনো পদ্ধতি নেই। ফলে আপনি বিভিন্ন ধরনের র্যাংকিং দেখতে পাবেন। আর এই র্যাংকিং নিয়ে যে বিশ্বে বিতর্ক নেই তা কিন্তু না। যেমন সম্প্রতি জুরিখ ইউনিভার্সিটি এ কারণেই যে-কোনো ধরনের র্যাংকিং থেকে বেরিয়ে এসেছে।
আহলে আপনি যদি বিবেচনা করেন, তাহলে মানসম্পন্ন শিক্ষা কোনটাকে বলবেন? দুই-তিনটা প্যারামিটার যদি বলতেন...
একটা হচ্ছে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ করা। শিক্ষককে গবেষণার জন্য আলাদা সময় দিতে হবে, ফান্ডিং দিতে হবে, জ্ঞানের আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের আনতে হবে। আমাদের এখান থেকেও পাঠাতে হবে। সভা-সেমিনার করতে হবে।
মান কি শুধু উচ্চ শিক্ষার, না প্রাথমিক থেকে শুরু করতে হবে?
শুধু প্রাথমিক নয়, প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করতে হবে। একজন শিক্ষার্থী যখন আন্ডার গ্র্যাজুয়েটে ভর্তি হয়, তখন ভাষা থেকে শুরু করে ব্যুৎপত্তি যদি তার না থাকে, আমি তাকে যা-ই পড়াই না কেন, সেটা তার জন্য একটা বোঝা হয়। তখন উচ্চ শিক্ষার যে একটা আনন্দের জায়গা আছে, সেটা সে মিস করে। আসলে বেসিক শিক্ষাটা শুরু হয় প্রাথমিক থেকে। সেটা না হলে তো সমস্যা থেকেই যায়।
আমরা দেখছি, প্রাথমিক শিক্ষার নানা ধরন আছে। সরকারি, বেসরকারি, মাদ্রাসা, ইংরেজি মাধ্যম। এটা কোনো সমস্যার সৃষ্টি করে কিনা, প্রাথমিক শিক্ষা ইউনিফায়েড হওয়া উচিত কিনা...
এটা তো একাধিক সমস্যা তৈরি করে। কিন্তু তিন-চার ধরনের শিক্ষা তুলে দিয়ে এক ধরনের শিক্ষা করতে হবে বলে আমরা বলি। কিন্তু এটা এই মূহুর্তে প্রাকটিক্যাল না। এখন মাদ্রাসা শিক্ষা আছে, বাংলা মাধ্যম আছে, ইংরেজি মাধ্যমও আছে। আপনি চাইলেই তিনটার মধ্যে দুইটা উঠিয়ে দিতে পারবেন না। আমাদের আসলে প্রয়োজন দীর্ঘ মেয়াদে শিক্ষার সংস্কার। আর সেটা করতে হলে আমাদের শিক্ষার দর্শনে যেতে হবে। শিক্ষানীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। আমার জনগণের কাছ থেকে শিক্ষার মাধ্যমে কী চাইছি।আমি তাকে মানবিক মানুষ হওয়া চাইছি, না সে ভালো কেরানী হবে বা প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ হবে। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, শিক্ষার দর্শন হবে একজন মানুষের পরিপূর্ণ সম্ভাবনা বিকশিত করা।
আমাদের যে পাঠক্রম, বই সেটা সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়। কনটেন্ট বদলায়। এটা শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করে, নাকি সুবিধা করে দেয়? সঠিক শিক্ষা বাধাগ্রস্ত করে কিনা...
অবশ্যই বাধাগ্রস্ত করে। যারা শিক্ষা ও শিক্ষণ নিয়ে কাজ করেন, তাদের গরেবষণায় দেখা গেছে, ১০ বছর পর্যন্ত বয়সের বাচ্চাদের যত ধাক্কা দেবেন, ওদের শিক্ষণ তত ক্ষাতগ্রস্ত হবে। আমরা যদি শিক্ষার কনটেন্ট বার বার দ্রুত বদলাতে থাকি, তাহলে শিক্ষার্থীদের ওপর একটা ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাদের লার্নিং ডিফিকাল্টির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
পরীক্ষাপদ্ধতিও বার বার পরিবর্তন করা হচ্ছে। এতে কি কোনো ক্ষতি হচ্ছে?
অবশ্যই- ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে। এটা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। শিক্ষায় রাষ্ট্রকে বিনিয়োগ করতে হবে। বিদেশি ফান্ড বা সহায়তা নিয়ে শিক্ষার উন্নয়ন হয় না। সে কারণেই যখন ইউএসআইডি ফান্ড করে, তখন তাদের ফর্মুলায় চলে। যখন ইউনিসেফ ফান্ড দেয়, তখন তাদের ফর্র্মুলায় চলে। তারা তো তাদের মতো করতে চায়। আমাদের দেশের বাস্তব অবস্থা তারা বিবেচনা করে না। আমাদের করতে হবে আমাদের দেশের উপযোগী শিক্ষা, পাঠক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতি। আর এখানে আমাদের সৃজণশীলতা থাকতে হবে।
শিক্ষায় এখানে বিনিয়োগ কেমন? সর্বোচ্চ গুরুত্বের কথা বলা হয়। আসলে কি তা করা হয়?
না না, আমাদের এখানে শিক্ষায় বিনিয়োগকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। বহুদিনের দাবি জিডিপির পাঁচ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ দেয়ার। সেটা তো হয় না। শিক্ষাকে ইনভেস্ট হিসেবে চিন্তা করতে হবে। কল্যাণমূখী রাষ্ট্র গঠন করতে হলে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। মানব সম্পদে এই বিনিয়োগ করে দেখেন চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ায় কী হয়েছে।
আমরা তো কর্মমুখী শিক্ষার কথা বলি। শুধু কি চাকরির জন্যই মানুষ শিখবে?
আসলে শিক্ষা তো একটা পরিবারের বিনিয়োগ। বাবা-মা চায় শিক্ষার মাধ্যমে তার সন্তান যেন ভালো থাকে। সেজন্য তাকে কাজ বা চাকরি করতে হবে। আমাদের আর্থ সামাজিক ব্যবস্থাকে বিবেচনায় নিতে হবে। একজন শুধু বিএ পাশ করে কী করবেন? তাকে পেশাগত দক্ষতা অর্জন করতে হবে, স্কিলড হতে হবে। এটা উন্নত বিশ্বেও করা হয়। আর আমাদের এখানে ভোকেশনাল শিক্ষাকে প্রান্তিক করে রাখা হয়েছে। আসলে দক্ষতা সবার এক বিষয়ে হয় না। তাই আমি বলেছি শিক্ষা হতে হবে যার যার প্রতিভা বিকাশের উপযুক্ত। সেটা হলে আর এই প্রশ্ন থাব বেনা।
প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকদের ভালো বেতন ও মর্যাদা না দিলে কি মেধাবী শিক্ষক পাওয়া যাবে? শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন হবে?
হবে না, কোনোদিন হবে না। আমরা নিজেদের কথা বলতে লজ্জা পাই। বিশ্বের কোথাও এই ধরনের পে-স্কেলে শিক্ষকরা পড়ান না। প্রাথমিকে তো প্রশ্নই ওঠে না। তাদের তো মানবেতর জীবন। খাবার নেই। কিন্তু মহান শিক্ষকরা আশা করবেন , সততা ও দক্ষতা আশা করবেন। এটা তো হয় না। শিক্ষকদের মান-সম্মানও এখন আর নেই। আগে শিক্ষকরা (বিশ্ববিদ্যালয়) সচিব পদ-মর্যাদা পর্যন্ত যেতে পারতেন, বিগত সরকারের আমলে সেটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আবার দেখেন, এখন গবেষণার সুযোগ আমলারা কুক্ষিগত করে নিচ্ছে। এটা তাদের চেয়ে শিক্ষকদের বেশি প্রয়োজন। কারণ, শিক্ষকরা সেটা শিক্ষার মান বাড়াতে কাজে লাগাবেন। কিন্তু আমলারা কী কাজে লাগাবেন?