1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শতবর্ষে সলিল চৌধুরী

১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

ভারতীয় সংগীত জগতে সলিল চৌধুরী একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকার, সুরকার৷ শতবর্ষে পা দিলেন তিনি। কলকাতায় চলছে তাঁর শতবর্ষ উদযাপন৷

https://p.dw.com/p/4oCzC
গীতিকার, সুরকার সলিল চৌধুরী
ছবি: Payel Samanta/DW

কথা ও সুরে প্রচলিত রীতিনীতি সরিয়ে ভারতীয় সংগীত জগতকে নতুন আলোর দিশা দেখিয়েছেন সলিল চৌধুরী(১৯২৫-১৯৯৫)। বাংলা গানকে তিনি অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন।

বাবা জ্ঞানেন্দ্র চৌধুরী ছিলেন পাশ্চাত্য গান-বাজনার বিশেষ অনুরাগী। চা বাগানে থাকার সুবাদে চা শ্রমিকদের সঙ্গে মেলামেশা সুযোগ হয়েছিল তার। গত শতকের চারের দশকের প্রথম দিকে গণ-আন্দোলনে যুক্ত হন সলিল চৌধুরী। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সদস্য হন।

গণসঙ্গীত ও সলিল চৌধুরী

গণসংগীত রচনার মাধ্যমে তার গানের জগতে প্রবেশ। ১৯৪৫ সালে বিদ্যাধরী নদীর ভয়ঙ্কর বন্যায় আক্রান্ত চাষী ভাইদের জন্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে তিনি তৈরি করেছেন তার প্রথম গণসংগীত, "দেশ ভেসেছে বানের জলে/ ধান গিয়েছে মরে।"

এই একই সময়ে কৃষক আন্দোলনে সক্রিয় কৃষকদের হয়ে তিনি তৈরি করেছেন, "পৌষালী বাতাসে পাকা ধানের বাসে", "আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে", "তোমার বুকে খুনের চিহ্ন খুঁজি এই আঁধারের রাতে"।

১৯৪৬ সালের নৌ বিদ্রোহ সমর্থন করে সলিল লিখলেন "ঢেউ উঠছে/ কারা টুটছে"। ২৯ শে জুলাই দেশব্যাপী ধর্মঘটের দিনে মনুমেন্টের নিচে অজস্র মানুষের সমাবেশে সেই গান গাওয়া হয়েছিল।

সলিলের আত্মজীবনীতে লেখা হয়েছে, "কমরেড বীরেশ মিশ্র ডেকে বললেন, উত্তরবঙ্গের রেল শ্রমিকদের মধ্যে ঘুরে ফিরে গান বাঁধতে হবে। রেল গাড়ির চাকার শব্দে যে ছন্দের স্পন্দন, তা থেকেই গান তৈরি হলো- ঢেউ উঠছে/ কারা টুটছে/ আলো ফুটছে/ প্রাণ জাগছে, জাগছে, জাগছে।"

অবিভক্ত বাংলার উনিশটা জেলায় ৬০ লক্ষ হিন্দু মুসলিম কৃষক দুই তৃতীয়াংশ মালিকানার দাবিতে তেভাগা আন্দোলন করেছিলেন। সলিল গান বাঁধলেন, "হেই সামালো ধান হো", "মানবো না এ বন্ধনে", "ও আলোর পথযাত্রী"।

যেমন ওয়েস্টার্ন, তেমনি ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যালে ওর খুব দখল ছিল: হৈমন্তী শুক্লা

বিদেশি ক্যয়ারের ধারায় আকৃষ্ট হয়ে সলিল বোম্বে ইউথ কয়্যার তৈরি করেন। পরপর ক্যালকাটা ইউথ কয়্যার এবং ন্যাশনাল ইউথ ক্যয়ার তৈরি করতে হাত লাগান। ১৯৭৯ সালে তার উদ্যোগে তৈরি হয় ক্যালকাটা কয়্যার৷

তারপরে সলিল তৈরি করলেন কলকাতা কয়্যার। ৪৬ বছরে পা দিয়েছে কলকাতা কয়্যার। ক্যালকাটা কয়্যারের ডিরেক্টর তথা সুরকার কল্যাণ সেন বরাট ডিডাব্লিউকে বললেন, "যে ধারা সলিল চৌধুরী গণ সংগীতে নিয়ে এসেছিলেন, সেটা কয়্যারের ধারা। যেটা এসেছে ইউরোপিয়ান চার্চ থেকে। সেই ধর্মীয় সংগীতের ধারাকে সেকুলারভাবে ব্যবহার করে বোম্বে ইউথ কয়্যার তৈরি করেন। গণনাট্য সংঘে এই অভিনব ধারার প্রচলন করেন। সলিলদা এখানে কয়্যার গানের জনক। সলিলদার সব গানেই, এমনকি আধুনিক গানেও সব সময় একটা প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি থাকতো।"

১৯৪৯ সালে সাধারণ মানুষের মুখে সলিল চৌধুরীর নাম ছড়িয়ে পড়লো যখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় রেকর্ড করলেন ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ'। বিষয়, সুর, আঙ্গিকে একদমই স্বতন্ত্র এই গান। এরপর ‘অবাক পৃথিবী‘ ‘রানার‘,  "ঠিকানা", ‘পালকি চলে' ইত্যাদি কবিতাতে সুর সংযোজন করেন তিনি।

গণসংগীতের ধারাতে নবজোয়ার আনে হেমন্ত- সলিল জুটির ‘ধিতাং ধিতাং বোলে‘, ‘পথে এবার নামো সাথী'। জনপ্রিয় হয় ‘শোনো কোনো একদিন', ‘দুরন্ত ঘুর্ণির', ‘আমি ঝড়ের কাছে', ‘আমায় প্রশ্ন করে' ইত্যাদি গান।

কল্যাণ সেন বরাটের মতে, ‘সব সময় মানুষের কথা তিনি বলেছেন তার গানে। এমনকি সেটা আধুনিক গানেও। ‘পথে এবার নামো সাথী', ‘অবাক পৃথিবী', ‘রানার', ‘কোন এক গাঁয়ের বধু' এইসব গান গ্রামোফোন কোম্পানি রেকর্ড করে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে। রেকর্ড কোম্পানি বাজারে যে জিনিসটা চলবে তার মূল্য বুঝেই রেকর্ড করেন। তাদের মধ্যে কোন প্রগতিবাদী চিন্তাভাবনা থাকে না। সলিলদা সেই গানগুলোতে বিনোদনের সঙ্গে প্রগতিশীল চিন্তা মিলিয়ে দিয়েছেন। এটা আমি অন্য কারো মধ্যে দেখিনি। ওর আগে এই ধরনের ভোকাল হারমনি,  ইন্সট্রুমেন্টেশন কখনো ব্যবহার হয়নি ভারতে।"

সলিল চৌধুরীর গণসংগীত কতটা আন্তর্জাতিক? কল্যাণ সেন বরাট বলেন, "সলিলদার গণসংগীত পুরোটাই আন্তর্জাতিক। লোকসঙ্গীতের ওপর যে সুরগুলো করেছেন তাতেও যে হারমোনির প্রয়োগ করেছেন, সেটা আন্তর্জাতিক স্তরের। রানার আদ্যন্ত একটা মাটির গান, সেখানে যে সুর প্রয়োগ করেছেন সেটা মাটির কাছাকাছি সুর, কিন্তু যেভাবে টনিক চেঞ্জ হয়েছে, যেমন ওয়েস্টার্ন সিম্ফনিতে হয়, সেটাতেই তাঁর মুন্সিয়ানা। বাংলার পথে ঘাটে রানারের যে পথ চলা সেটা কিন্তু কোথাও বিঘ্নিত হয়নি। কিন্তু সুরের মধ্যে ছয় বার টনিক চেঞ্জ হয়েছে।"

সলিল চৌধুরীর বাড়ি
দক্ষিণ কলকাতায় সলিল চৌধুরীর বাড়িছবি: Payel Samanta/DW

প্লে ব্যাক সংগীতের জগতে

পঞ্চাশের দশকে বাঙালি শ্রোতা যখন সলিল চৌধুরীকে চিনে ফেলেছেন, তখন তিনি পাড়ি দিলেন বোম্বাই।

সলিল চৌধুরীর লেখা রিক্সাওয়ালা গল্প অবলম্বনে পরিচালক বিমল রায় তৈরি করেছেন ‘দো বিঘা জমিন'। ছবির চিত্রনাট্যকার সলিল চৌধুরী পেলেন সুরকার হিসেবেও দায়িত্ব। গীতিকার শৈলেন্দ্রের কথায় সুর দিলেন সলিল। আসমুদ্র হিমাচল সেই সুর লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল- 'ধরতি কহে পুকারকে, বীজ বিছালে প্যার কে, মৌসম বিতা যায়, মৌসম বিতা যায়।'

এরপর ‘মধুমতী' সিনেমার গানগুলোতে সারা ভারত মজে গিয়েছিল- 'আজা রে পরদেশী', 'চড় গয়ি পাপি বিছুয়া', 'দিল তড়প তড়প কে কহে রহা হ্যায়', 'ঘড়ি ঘড়ি মেরা দিল ধড়কে', 'সুহানা সফর ঔর ইয়ে মৌসম হাসিন'। এরপর হিন্দি ছবির গানে সলিল চৌধুরীকে থামানো যায়নি। "আনন্দ", ‘ছায়া', ‘পরখ', ‘মেরে আপনে' ইত্যাদি অসংখ্য ছবিতে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল সলিল চৌধুরীর সুর।

গণসংগীত এর প্রভাব সলিল চৌধুরীর পরবর্তী প্লেব্যাক সংগীতে কতটা? কল্যাণ সেন বরাট বলেন, "উনি যখন নিজে লিখেছেন গান বা সুর করেছেন তাতে সবসময় গণসংগীতের একটা প্রভাব ছিল। যখন উনি হিন্দি বা মালায়ালাম ছবিতে সুর করেছেন তখন গীতিকারদের মানুষের কথা লেখার কথা বলতেন। 'দো বিঘা জমিন' এর গান গুলো গণসংগীতের মতই।"

প্রায় ষাটটি হিন্দি ছবিতে সুর দিয়েছেন সলিল। লতা মঙ্গেশকার, মুকেশ, তালাত মাহমুদ, যেসুদাস, আশা ভোঁসলেকে দিয়ে গাইছেন জনপ্রিয় সব গান।

তার সুরের এত জনপ্রিয়তার কারণ কী?

বিখ্যাত সংগীতশিল্পী হৈমন্তী শুক্লা ডিডাব্লিউকে বলেন, "উনি ওর সময়ের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন। উনি সেই সময় যে গান করে গিয়েছেন তা আজকের দিনে ভীষণভাবে প্রযোজ্য। দো বিঘা জমিন, আনন্দ, পরখ, মায়া, রজনীগন্ধা ছবির গানগুলো এখনো জনপ্রিয় সমান ভাবে। যেমন ওয়েস্টার্ন, তেমনি ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যালে ওর খুব দখল ছিল।"

ছায়া সিনেমার 'ইতনা না মুঝসে তু পেয়ার বড়া' গানটা মোৎজার্ট এর সিম্ফনি থেকে সুর নেওয়া। তাতে সলিল চৌধুরী নিজের ছোঁয়া দিয়েছেন। মোৎজার্টকে ভেঙে ভৈরবী ধাঁঝের সুরে তালাত মাহমুদ ও লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে ডুয়েট গাইয়েছেন।

এই যে ভারতীয় সংগীতের সঙ্গে ওয়েস্টার্ন হারমোনি, কয়ার অর্কেস্ট্রা এমনভাবে সলিল চৌধুরীর জুড়েছেন, যাতে সেটা বিদেশি হয়েও ভারতীয় আত্মায় মিশে গিয়েছে। এই সম্পর্কে হৈমন্তী বলেন, "সলিলদার ক্ষেত্রে কখনো ভারতীয় সংগীতের সঙ্গে পাশ্চাত্যের সংঘর্ষ হয়নি। উনি ভীষণভাবে এগুলো গ্রহণ করতেন। সেসব ভেঙে নিজের স্টাইলে গানটা করতেন৷’’

আধুনিক বাংলা গানে

বাংলা গানের মাইল ফলকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সলিলের সুরে লতা মঙ্গেশকরের গান। সাত ভাই চম্পা, না যেওনা, ওগো আর কিছু তো নাই, ও মোর ময়না গো, পামাগারেসা।

এসব গানের প্রসঙ্গে হৈমন্তী বলেন, "ছোটবেলায় ওর তৈরি লতাজির গাওয়া আজ নয় গুনগুন, ও বাঁশি কেন আমরা নিজেরাই গাইতাম। তখন ওকে চিনতাম না৷’’

সলিল চৌধুরীর সঙ্গে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা হৈমন্তী শুক্লার। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, "সলিলদা আমাকে চিনতেন না। আমার গান শুনে একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন। ১৯৮৭ থেকে সলিলদার সঙ্গে কাজ করা শুরু করেছি। প্রথমে মান্না দার সঙ্গে একটা ডুয়েট গাওয়ালেন। তারপর হারানের নাত জামাই ছবিতে পল্লীগীতি গাইয়েছিলেন৷’’

শাস্ত্রীয় ঘরানার সংগীতশিল্পী হিসেবে পরিচিত হৈমন্তী শুক্লা সলিল চৌধুরীর সুরে গান গাইতে চাইতেন। তার বক্তব্য, "এরপর আমি সলিল দা কে বললাম, আপনার সুরে গাইতে চাই। সলিলদা বললেন, তুই তো ক্লাসিক্যাল! যেহেতু আমার বাবা শাস্ত্রীয় সংগীত জগতের মানুষ, আমিও এই ধরনের গান গাইতাম। তবে আমি শুধু শাস্ত্রীয় সংগীত গাইতে চাইতাম না। সব ধরনের গান গাইতে চাইতাম। তখন প্রথমে উনি আমাকে একটা ক্লাসিক্যাল অঙ্গের গান দিয়েছিলেন। পরে ১৯৮৩ তে "এইবার স্বপ্নের বন্ধন খুললাম" গাইলাম সলিলদার কথা ও সুরে। ওই বছরই "ভালবাসি বলেই ভালবাসি বলি না" গাইলাম। যেমন কথা, তেমনি সুর, কি সুন্দর গান!’’

আমার মতে, এই গান চিরকাল থাকবে: অন্তরা চৌধুরী

সলিল চৌধুরীর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য সংগীত মেশানোর রীতি কেমন লাগতো? হৈমন্তী বলেন, "খুব ভালো লাগতো। এতো ভালো লাগতো যে বলে বোঝানো যাবে না। "মন বন পাখি চন্দনা" গানটা একাধারে শাস্ত্রীয় ও ওয়েস্টার্ন। এই গানটাতে খুব তান সারগম ছিল। উনি গানটা রেকর্ডের পর ছেলেমানুষী করে বলেছিলেন, "তোর ওস্তাদদের এই গানটা একটু শুনিয়ে দিস, গানটা কেমন বানিয়েছি!’’

সলিল চৌধুরীর সুরে বাংলা গান গেয়েছেন কিশোর কুমার, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, সবিতা চৌধুরী, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, সুবীর সেন, পিন্টু ভট্টাচার্য, অনুপ ঘোষাল, সাগর সেন, অরুন্ধতী হোম চৌধুরী প্রমুখ প্রথিতযশা সংগীত শিল্পী।

হৈমন্তী বলেন, "উনি খুব আর্টিস্ট চিনতেন। কাকে দিয়ে কোন গানটা ভালো হবে এটা খুব বুঝতেন। 'সেদিন আর কত দূরে' এই গানটা অনেকেই গেয়েছেন। কিন্তু উনি আমাকে দিয়ে রেকর্ড করিয়েছেন। সলিল দা যেভাবে নিজে গাইতেন, সেটা নকল করে দিতে পারলেই আমাদের গান ভালো হয়ে যেত। আমি খুব চেষ্টা করতাম তিনি যেভাবে গাইছেন সেভাবে গাইতে৷’’

ছোটদের গান

বাঙালির শৈশব মানে বাড়িতে সলিল চৌধুরীর ছোটদের গানের ক্যাসেট অবশ্যই থাকবে। সেই ক্যাসেটের ওপর থাকতো অল্প বয়সি অন্তরা চৌধুরীর হাসিমুখ। 'বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে', 'সোনা ব্যাঙ ও কোলা ব্যাঙ', 'এক যে ছিল মাছি', 'হবু চন্দ্র গোবু চন্দ্র', 'পুজোর গন্ধ এসেছে', 'ইস্কাবনের দেশে', 'খুকুমণি গো সোনা', 'ও মাগো মা' ইত্যাদি গান বাঙালি শিশুদের এখনো মাতিয়ে রাখে।

সলিল কন্যা গায়িকা অন্তরা চৌধুরী ডিডাব্লিউকে বলেন, "অন্যান্য গানের মতই সলিল চৌধুরীর ছোটদের গানে শুধু প্রাঞ্জল ভাষা বা স্বচ্ছ ধারণা নয়, তার মধ্যে মানুষের কথা, সামাজিক বার্তা থাকে। পাশাপাশি বাবার যে সুর এটা একটা আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে গানে। আমার মতে এই গান চিরকাল থাকবে। বাচ্চারা এখনো এই গানগুলো খুব মজা করে গায়। এই গান কোনদিন পুরনো হবে না।"

অন্তরা মনে করেন শিশুদের জন্য আরও বাংলা গান তৈরি করা উচিত। তার বক্তব্য, "আমি খুব ভাগ্যবান যে আমি এই পরিবারে জন্মেছিলাম এবং এই সময় এই গানগুলো গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। বাচ্চাদের জন্য এরকম গান আর হচ্ছে না। আমার মনে হয় বাচ্চাদের জন্য আরেকটু ভাবার দরকার আছে! আমি যে গানগুলো করেছিলাম তারপর আর কেউ সেভাবে বাচ্চাদের গানের কথা ভাবছেন না কেন? আমি মনে করি এখনকার গীতিকার সুরকার কে বাচ্চাদের গানের কথা একটু ভাবতে হবে।"

সলিল চৌধুরীর গান সংরক্ষণ

সলিল চৌধুরীর জন্ম শতবর্ষ উপলক্ষে জন্মশতবর্ষ কমিটি গঠন করেছেন অন্তরা। লক্ষ্য আছে একটা মিউজিয়াম তৈরির। অন্তরা বলেন, "পরের বছর বাবাকে নিয়ে একটা তিন দিনব্যাপী প্রদর্শনী করার কথা ভেবেছি। যেখানে বাবার সব লেখা, খাতা, কলম, জামা কাপড়, হারমোনিয়াম, চশমা, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ইত্যাদি থাকবে। নোটেশানের বই বেরোনোর পরিকল্পনা করেছি। ইতিমধ্যে ৫০টা গান তৈরি হয়ে গেছে। ভুলভাল সুরে যাতে সলিল চৌধুরীর গান না গাওয়া হয় সে জন্যেই গীতবিতান বা স্বরবিতান এর মত সলিল সংগীতের নোটেশনেরর বই বের করা হবে। ধারাবাহিকভাবে এই বই বেরোবে। সলিল রচনা সংগ্রহ পার্ট টু এই বছর বেরোবে। প্রথম ভাগে ৫০০ টা গান ছিল, দ্বিতীয় ভাগে সলিল চৌধুরীর নাটক, ছোট গল্প, আর্টিকেল, প্রথম থেকে শেষ অবধি বাবার কাজের বিশদ ইতিহাস থাকবে। এই কাজ চলছে৷’’

শুধু শতবর্ষ উদযাপন নয়, অন্তরার লক্ষ্য আরো অনেক দূর। তিনি বলেন, "বাবার গানগুলো জেলায় জেলায় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সঠিকভাবে গানগুলোকে শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছি। শুধু শতবর্ষ পালনের জন্য নয়, এই কাজটা চলবে আগামী দিনেও। বর্ধমানে গিয়ে বাচ্চাদের দুটো গান শিখিয়ে এসেছি।  বাবার গানগুলো যদি ঠিক মত গাওয়া যায়, তার একটা আলাদা প্রভাব থাকবেই। বাবার ছোট গল্প ড্রেসিং টেবিল এর নাট্যরূপ করার পরিকল্পনা আছে। আর বাচ্চাদের গানের কমিকস বইও বেরিয়েছে৷’’

হিন্দি ও বাংলা সহ ভারতের ১৪ টি ভাষায় গান বেঁধেছিলেন সলিল। সলিলের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার আমরা কিভাবে সমৃদ্ধ করতে পারি? অন্তরা বলেন, ‘‘সলিল চৌধুরীর কাজ বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। যারা সুস্থ সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে চান, তাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।  সলিল ভক্তদের প্রত্যেকের দায়িত্ব এই কাজগুলোকে ভালো করে সংরক্ষণ করে রাখা এবং পরের প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া। শুধু গান নয়, বাবার বিভিন্ন লেখা, অনেক ছবিতে বাবার গল্প ব্যবহার হয়েছে, (সেগুলো অনেকে জানেন না যেমন,  দো বিঘা জামিন , পরখ , মিনু ছবিতে বাবার গল্প ব্যবহার হয়েছে)। আমরা যে আর্কাইভ বা মিউজিয়াম করব তাতে এরকম সমস্ত কিছু রাখবো যাতে মানুষ জানতে পারেন সলিল চৌধুরীকে৷’’

মানুষ সলিল চৌধুরী

সুরকার সলিল চৌধুরীর মৃত্যুর পর বোম্বের সুরকার নওশাদ বলেছিলেন, "ফ্রম আওয়ার সেভেন নোটস, ওয়ান ইজ নো মোর।" তবুও তিনি তার গানে, কথায়, সুরে রয়ে গিয়েছেন মানুষের মধ্যেই।

সলিল চৌধুরীকে নিয়ে লেখা বই
সলিল চৌধুরীকে নিয়ে লেখা বইছবি: Payel Samanta/DW

সলিল চৌধুরীর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? কল্যাণ সেন বরাট বলেন, ‘‘সলিলদার একটা কোম্পানি ছিল সেন্টার ফর মিউজিক রিসার্চ (সিএমআর)। সেখান থেকেই প্রথম আমাদের অফার দেয়া হয় একটা গণসংগীত এর রেকর্ড বের করার জন্য। আমরা প্রথম ওনর কোম্পানি থেকেই রেকর্ড বের করি। একটি পয়সা না নিয়ে তিনি চারটি গান আমাদের দিয়েছেন রেকর্ড করার জন্য। শুরুর দিক থেকেই সলিল চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। সুরকার, গীতিকার, সংগঠক, মানুষ সলিল চৌধুরীকে মানুষের স্বার্থে কাজ করতে দেখেছি। আন্দোলনের মাঠে দাঁড়িয়ে উনি গান তৈরি করেছেন। ওর সঙ্গে দেখা না হলে জীবনটাই অপূর্ণ থেকে যেত৷’’

হৈমন্তী শুক্লার কথায়, "প্রতিবছর জন্মদিনে উনি আমাকে বাড়িতে ডাকতেন। ওর বাড়িতে গান শিখতে গেলে কোন কোন দিন গান হতো না। চা খেয়ে গল্প করে চলে আসতাম। আমি জর্দা খাই খুব। ব্যাগের মধ্যে একটা দামী জর্দা রেখে দিতাম। সলিলদার কাছে গেলেই উনি চোখের ইশারায় জর্দা চাইতেন। এমনই রসিক মানুষ ছিলেন তিনি। সবিতাদি এ জন্য বকাবকি করতেন৷’’

সুরকার গীতিকার ও গায়ক সলিল চৌধুরীকে এক আসনে বসাতে চান তিনি। তার বক্তব্য, "ছাত্রছাত্রীরা সবাই বলে সলিলদার গান খুব কঠিন কিন্তু গাইবার সময় তা মনে হয় না। সলিলদা কে সুরকার গীতিকার এবং গায়ক হিসেবে আমি এক জায়গাতে রাখবো। "এই রোকো পৃথিবীর গাড়িটা থামাও" অনেক বছর আগে উনি দিয়ে গেছেন। সেই গান এখন সমাদৃত হয়েছে ব্যাপকভাবে৷’’

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷