‘শিক্ষার্থীদের একটা অংশের ঝরে পড়ার শঙ্কা আছে'
২১ মে ২০২১ডয়চে ভেলে : করোনার মধ্যে তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, শিক্ষা ব্যবস্থা সচল রাখতে আপনারা কী উদ্যোগ নিয়েছেন?
অধ্যাপক নেহাল আহমেদ: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমরা সরাসরি ক্লাস নিতে পারছি না, শিক্ষকরা সামনাসামনি যেভাবে ক্লাস নেন সেভাবে হয়ত হচ্ছে না, কিন্তু সারাদেশে ভার্চুয়ালি অনলাইনের মাধ্যমে ক্লাস নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে৷ তবে এটাতে অনেক জায়গায় যাওয়া যায়নি৷ যেমন দ্বীপ, হাওর, পাহাড়ি অঞ্চলে নেটওয়ার্কে সমস্যা আছে৷ আর সব বাচ্চাদের তো ডিভাইসটা নেই হাতে৷ এখন পর্যন্ত আমরা অনলাইনের উপর নির্ভর করছি এবং ওই ক্লাসগুলো আবার ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে৷ কেউ যদি ক্লাস মিস করে তাহলে পরবর্তী সময়ে যেখানে নেটওয়ার্ক আছে সেখানে গিয়ে ইউটিউব থেকে ডাউনলোড করে নিতে পারছে৷ আপাতত এই অবস্থার মধ্যে আছি৷ আর আমরা অপেক্ষা করছি, করোনা পরিস্থিতি যদি একটু স্বাভাবিক হয় তাহলে সরাসরি ক্লাসে চলে যাবো৷
অনলাইনে ক্লাস নেওয়া বা ইউটিউবে পাওয়া গেলেও তো সেখানে অনেক শিক্ষার্থী অংশ নিতে পারছে না৷ এতে কি শিক্ষায় বৈষম্য বাড়বে না?
শিক্ষার বৈষম্য বাড়বে ঠিক৷ কিন্তু এই মুহুর্তে তো আমাদের সামনে বিকল্প কিছু নেই৷ সারাদেশে তো আমাদের নেটওয়ার্ক অতটা সবল না৷ আর অন্তত একটা স্মার্টফোন তো সবার হাতে নেই৷ অনেক গরিব ছাত্র আছে তাদের হাতে এটা নেই৷ কিছু তো বৈষম্য আছে৷ তারপরও আমাদের একটা বিশাল অংশ কিন্তু অনলাইনে পড়ছে৷ আর যাদের নেই তারা কিন্তু পরবর্তীতে বন্ধুর কাছ থেকে বা কারো কাছ থেকে ফোন চেয়ে নিয়ে ডাউনলোড করে নিতে পারে৷ এই সুযোগটা রাখা হয়েছে৷
গত বছর তো পরীক্ষা ছাড়াই শিক্ষার্থীদের পরবর্তী কাসে তুলে দেওয়া হলো৷ এবার কী করবেন?
এখন আমরা অপেক্ষায় আছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্লাসে ফিরে যাওয়ার৷ আমাদের তো চিন্তাভাবনা ছিল গত মার্চ মাসে ক্লাসে যাওয়ার, কিন্তু সেটা তো পারিনি৷ তখন তো করোনা পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে গেল৷ আগামী এক মাসের মধ্যে আমরা ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্খায় আছি৷
আগামী জুনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার চিন্তা করা হচ্ছে, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সেটা কি সম্ভব হবে?
করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে তো সেটা সম্ভব হবে না৷ পৃথিবীর সব জায়গায় কিন্তু খুলছে, আবার বন্ধ করে দিতে হচ্ছে৷ আমাদের শিক্ষকদের একটা বড় অংশ কিন্তু টিকা নিয়ে নিয়েছে৷ ছাত্রদের এখন দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে৷ এটা যদি পারা যায় তাহলে আমরা খানিকটা পজিটিভ জায়গায় চলে আসবো৷ ইংল্যান্ডে আমরা গতকাল দেখলাম ওদের অনেক কিছু খুলে দিয়েছে৷ কারণ হলো তারা টিকা কার্যক্রমটা ব্যাপকভাবে চালাতে পেরেছে৷ বাংলাদেশে তো সেই বাস্তবতাটা এখনো হয়নি৷ তবে আমরা আশাবাদী আমাদের করোনা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে৷ সেই আকাঙ্খা থেকে আমরা জুন-জুলাইয়ে স্কুল খোলার কথা বলছি৷
উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষার্থীদের ভাগ করে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে? আপনারা কি এমন কিছু ভেবেছেন?
হ্যাঁ, আমাদের এখানেও ক্লাসের সাইজ আমরা ছোট করে ফেলবো৷ ধরেন একটা ক্লাসে যদি ৬০ জন থাকে, সেটা আমরা ৩০ জনে নামিয়ে আনবো, যাতে ক্লাসে ছেলে-মেয়েরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাস করতে পারেন৷ সব ক্লাস একসঙ্গে স্কুলে যাবে সেই চিন্তাভাবনা আমাদের নেই৷ শুধুমাত্র এসএসসি ও এইচএসসির পরীক্ষার্থী যারা তারা প্রতিদিন স্কুল বা কলেজে আসবে৷ আর অন্য ক্লাসের ক্ষেত্রে রোববারে হয়ত ক্লাস সিক্স, সোমবারে ক্লাস সেভেন এভাবে করার চিন্তা আছে৷
দীর্ঘদিন স্কুল-কলেজ এভাবে বন্ধ থাকলে তো পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে একটা সংকট তৈরি হবে?
এই সংকট তো শুধু বাংলাদেশ না, সারা পৃথিবীতেই৷ মাঝখানে অ্যামেরিকায় একবার স্কুল খোলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু দেখা গেল এক মাসে একলাখেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রী আক্রান্ত হয়ে গেল৷ তখন সঙ্গে সঙ্গে আবার বন্ধ করে দিয়েছে৷ এখন এটা তো আমাদের হাতে নেই৷ অপেক্ষা করা ছাড়া তো আর কিছু করার নেই৷ আমাদের কাছে তো কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জীবন আগে৷ শিক্ষার তো ক্ষতি হচ্ছে এটা নিঃসন্দেহে৷ একটা প্রজন্ম শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে৷ তারপরও তো জীবনের চেয়ে কোনো কিছু বড় না৷
স্কুল খুললেও গণপরিবহন যদি না চলে তাহলে তো সব শিক্ষার্থী স্কুলে যেতে পারবে না?
যখন আমরা স্কুল খুলবো, তখন সেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবো, ছেলেমেয়েরা যাবে কীভাবে সেটা তো আমাদের দেখতে হবে৷ তাদের স্কুলে আসার ব্যবস্থা করেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবো৷ গ্রামে তো এটা লাগে না, তারা হেঁটেই স্কুলে চলে যায়৷ বিশেষ করে কয়েকটি মহানগরী যেমন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এই শহরগুলোতে সমস্যা বেশি৷ অন্য জেলা শহরগুলোতেও গণপরিবহন কোনো ফ্যাক্টর না৷
প্রায় দেড় বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, এই সময়ে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় যে ঘাটতি হয়েছে সেটা কিভাবে পূরণ করা সম্ভব?
আমরা প্রত্যেক ক্লাসের জন্য সংক্ষিপ্ত সিলেবাস করে দিয়েছি৷ যেটা একেবারেই না পড়লে নয়, সেটাই শুধু পড়ানো হবে৷ পরবর্তী ক্লাসে উঠার পর যেন কোনো সংকট না হয় সেদিকে খেয়াল রেখেই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে এটা করা হয়েছে৷ শুধু আবশ্যকীয় চ্যাপ্টারগুলো কাটছাঁট করে পড়ানো হবে৷ প্রতি ক্লাসেই এভাবে যেতে হবে৷ আমাদের তো পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতেই হবে, বিকল্প তো কিছু করার নেই৷ অনেক অভিভাবক ছেলে-মেয়েদের ক্লাসে পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন৷ আবার অনেক অভিভাবক বলছেন, কেন আমরা স্কুল খুলছি না৷ দুই ধরনেরই অভিভাবক আছে৷
দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার কি বেড়ে যেতে পারে?
অবশ্যই বেড়ে যেতে পারে৷ বিশেষ করে মেয়েরা৷ গ্রামাঞ্চলে অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা আছে৷ অনেক ছেলে-মেয়ে হয়ত স্কুলে না এসে অন্য কাজ-কর্মে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শিক্ষকদের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া আছে যে, যারা স্কুলে আসবে না তাদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেওয়া এবং অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার৷ আমাদের মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সেই উদ্যোগ নেওয়া হবে৷
এই ঝরে পড়া রোধ করতে এর মধ্যে আপনারা কি কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন?
যারা ঝরে পড়েছে সেটা তো এখন আমরা জানি না৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খুললে তো সেটা আমরা জানতে পারবো না৷ এটা আমরা আন্দাজ করছি, কিন্তু সত্যিকারের পরিসংখ্যান তো আমাদের কাছে নেই৷ স্কুল খোলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বিষয়টা জানতে পারবো৷ তবে আমাদের একটা নির্দেশনা আছে, স্কুল খোলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দেখবো কারা স্কুলে আসছে না৷ তাদের বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিতে হবে কেন তারা আসছে না৷ এবং তাদের আবার ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে৷
করোনা পরিস্থিতির মধ্যে কি আপনারা শিক্ষার্থীদের খোঁজ -খবর নিয়েছেন?
প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই চেষ্টা করেছে তাদের সাধ্যমতো৷ শহরঅঞ্চলে সমস্যা, কিন্তু তাপরপরও শিক্ষাকরা ফোনে চেষ্টা করেছেন৷ আর গ্রামাঞ্চলে শিক্ষকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, তারা যেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীদের খোঁজ নেয়৷ সেই প্রচেষ্টাটা আছে৷ তারপরও পূর্ণচিত্রটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খুললে পাওয়া যাবে না৷
বর্তমানে যে দিশেহারা শিক্ষা ব্যবস্থা, সেটা থেকে উত্তরণে সামনের দিনগুলোতে আপনাদের পরিকল্পনা কী?
এটা তো সারা বিশ্বের সমস্যা৷ করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আমাদের বারবার এই চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে পড়তেই হবে৷ আমরা যদি প্রতিষ্ঠান খুলতে পারি, তাহলে ছুটিগুলো কমিয়ে দেবো৷ আমাদের সামারের ছুটি থাকে, রোজায় ছুটি থাকে, শুক্র বা শনিবার বন্ধ থাকে৷ এই বন্ধের দিনগুলোতে ক্লাসের সংখ্যা বাড়িয়ে চেষ্টা করা হবে ছাত্রদের যতটা পুষিয়ে দেওয়া যায়৷ এখন শুরুটা করা দরকার৷ শুরু করতে পারলে সত্যিকারের চ্যালেঞ্জগুলো আমরা বুঝতে পারবো৷ ইতিমধ্যে বেশ কিছু পরিকল্পনা হয়েছে, সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হবে আশা করি৷