‘শেখ হাসিনাকে আইনের আওতায় আনার যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ আছে'
১৫ ডিসেম্বর ২০২৪বিশ্লেষকরা বলছেন, কমিশন যেসব তথ্য প্রমাণ এবং জবানবন্দি নিয়েছে তা আইন অনুযায়ী আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হবে৷ তবে গুমের শিকার পরিবারগুলোর সদস্যদের সংগঠন ‘মায়ের ডাকের' প্রধান সানজিদা ইসলাম তুলি কমিশনের কাজে এখনো আশান্বিত হওয়ার কিছু দেখছেন না৷
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত গুম সংক্রান্ত কমিশন শনিবার শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে গুমের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের রিপোর্ট হস্তান্তর করেছে৷ আর সেই রিপোর্টে তারা বলেছে, গুমের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে৷ শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ যেসব কর্মকর্তার জড়িত থাকার প্রমাণ তারা পেয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন, শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকী, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান এবং পুলিশ কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ৷
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গুমের সঙ্গে কীভাবে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেল জানতে চাইলে কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, ‘‘আমরা তদন্ত করতে গিয়ে সামরিক ও বেসামরিক অনেক ব্যক্তির জবানবন্দি নিয়েছি৷ ডকুমেন্টও সংগ্রহ করেছি৷ তাতে বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতা যারা গুম হয়েছেন তাদের শেখ হাসিনার অনুমোদন নিয়েই গুম করা হয়েছে বলে তথ্য পেয়েছি৷ যেসব কর্মকর্তরা এই কাজে ছিলেন, যাদের আমরা নাম বলেছি তারা এইসব বিষয়ে সরাসরি শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলতে পারতেন৷ আমরা দেখেছি র্যাব আটকের পর গুম করার জন্য কোন কোন পর্যায়ে যোগাযোগ করতো৷ সিদ্ধান্তটা তারা নিতোনা৷ তারা প্রধানমন্ত্রীর অফিস বা তার থেকে সিগন্যালের অপেক্ষায় থাকত৷ পুলিশ, র্যাব ও সেনবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি গ্রুপ ছিলো যারা আসলে শেখ হাসিনার অনুমোদন নিতো৷ আর এইসব ক্ষেত্রে তারা কোড ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করত৷ যেমন র্যাবকে বলত ‘কালো কাক'৷ তবে নিরাপত্তার স্বার্থে এখন কারা আমাদের এই তথ্য দিয়েছেন, ডকুমেন্টগুলো কী তা প্রকাশ করছিনা৷ মামলার প্রয়োজনে আমরা দেখব,'' বলেন তিনি৷
তার কথা, ‘‘শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গুম নিয়ে মামলা করা এখন সরকার ও ভিকটিমদের পরিবারের সিদ্ধান্ত৷ তবে আমাদের কাছে যে সাক্ষ্য প্রমাণ আছে তা তার বিরুদ্ধে গুমের ফৌজদারি মামলা করার জন্য যথেষ্ঠ৷''
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনাগুলো তদন্ত করতে অন্তর্বর্তী সরকার গত ২৭ আগস্ট এই কমিশন গঠন করে৷ কমিশনে র্যাব, ডিজিএফআই, ডিবি, সিটিটিসি, সিআইডি, পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে৷ কমিশনে এক হাজার ৬৭৬টি অভিযোগ জমা পড়েছে৷ ৭৫৮ জনের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করেছেন তারা৷ তার মধ্যে ৭৩ শতাংশ ভুক্তভোগী ফিরে এসেছেন৷ বাকি ২৭ শতাংশ ( ২০৪ জন ব্যক্তি) এখনো নিখোঁজ রয়েছেন৷
নূর খান জানান, কমিশনের এটা প্রাথমিক প্রতিবেদন৷ কমিশনের কাজ অব্যাহত থাকবে৷
তিনি বলেন, ‘‘র্যাব নিষিদ্ধের কথা বলেছি আমরা এই কারণে যে এটা পুলিশের একটি বাহিনী বলা হলেও এটা আসলে পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করেনা৷ র্যাবের ডিজি পুলিশ থেকে হয়, কিন্তু তার পদটি অলঙ্কারিক৷ মূল ক্ষমতা অতিরিক্ত ডিজি অপারেশন এবং গোয়েন্দা পরিচালকের হাতে৷ তারা সেনাবাহিনী থেকে আসে৷ কমান্ডিং অফিসার থেকে সব পর্যায়েই সেনা কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়৷ এটা একটা গেস্টাপো বাহিনীর মতো৷ আমরা র্যাবে অনেক সিক্রেট টর্চার সেল পেয়েছি৷ সবাই শুধু আয়না ঘরের কথা বলে৷ ওটা ডিজিএফআই-এর৷ র্যাবে অনেক আয়নাঘর আছে৷''
তবে ‘মায়ের ডাকের' প্রধান সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, ‘‘তারা একটি রিপোর্ট দিয়েছে তা আমাদের কী কাজে লাগবে তা বুঝতে পারছিনা৷ আমরা চাই বিচার৷ আমরা শেখ হাসিনাসহ যারা এই গুমের সঙ্গে জড়িত সবার বিচার চাই৷ এখন তাদের কাছে যেসব ডকুমেন্ট বা তথ্য প্রমাণ আছে তা পাবলিক করা হোক বা আমাদের দেয়া হোক, যেন আমরা মামলায় কাজে লাগাতে পারি৷''
‘‘তিন মাস ধরে তারা যে কাজ করেছে তাতে আমরা এখনো আশা দেখতে পারছিনা৷ আমর চাই তারা সরাসরি তথ্য প্রমাণ দিয়ে ভিকটিম পরিবারগুলোকে সহায়তা করুক৷ আইনি লড়াইয়ে পাশে থাকুক৷ রাষ্ট্র এজন্য সহায়তা সেলও খুলতে পারে,'' বলেন তিনি৷
তার কথা, ‘‘শেখ হাসিনা যে এইসব গুমের সঙ্গে জড়িত তা তো আমরা সবাই জানি৷ কিন্তু তিনি যে জড়িত তার ডকুমেন্ট বা তথ্য প্রমাণ আমাদের দরকার৷ কমিশন আমাদের সেই তথ্য প্রমাণ দিক, যাতে আমরা মামলায় কাজে লাগাতে পারি,'' বলেন তিনি৷
আর পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান বলেন, ‘‘এই কমিশনের যে স্ট্যাটাস তাতে তাদের ডকুমেন্টে, তাদের নেয়া জবানবন্দি সব কিছু আদালত গ্রহণ করবে৷ এইসব ঘটনায় অনেক মামলা হয়েছে৷ আবার মামলার বাইরেও আছে বা মামলা নেয়া হয়নি৷ এখন মামলায় জোর দেয়া দরকার৷ যারা ঘটনাগুলোতে কমনভাবে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলাও করা যায়৷ আবার মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অবরাধ ট্রাইব্যুনালেও মামলা করা যায়৷ আসলে এগুলো এখন সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়৷''
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘‘মামলা তো আছে৷ আর মামলার প্রক্রিয়া চলছে৷ শেখ হাসিনাসহ তার সরকারের শীর্ষ যেসব কর্মকর্তার জড়িত থাকার প্রমাণ কমিশন পেয়েছে তার ভিত্তিতেই তাদের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে৷ মামলা হলে কমিশন তাদের সাক্ষ্য প্রমাণ, জবাবন্দি আদালতে হাজির করবেন৷ আদালত তা বিবেচনা করে দেখবেন৷''