সাফাইকর্মীদের পা ধুয়ে কটাক্ষের মুখে মোদী
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ভারতে সাধারণ নির্বাচনের আর বেশি দেরি নেই৷ শাসক ও বিরোধী পক্ষ ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার আগেই নেমে পড়েছে প্রচারে৷ এরই মধ্যেই বেশ চমক সৃষ্টি করেছেন প্রধানমন্ত্রী৷ রবিবার তিনি উত্তরপ্রদেশে কুম্ভের সঙ্গমে স্নান সেরে গেরুয়া বসন পরে পুজো করেন৷ তারপর পাঁচ সাফাইকর্মীর পা ধুয়ে দেন৷ এই কর্মীরা কুম্ভমেলা সাফাইয়ের কাজে নিযুক্ত৷ দূরদর্শনে সরাসরি এই ছবি দেখা গেছে৷ মোদী জল দিয়ে নরেশ কুমার, ছবি, পেয়ারে লাল, জ্যোতি ও হোরি লাল নামে দলিত সাফাইকর্মীদের পা ধুয়ে দিয়েছেন৷
ভোটের আগে এই পর্ব যথারীতি নয়া আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে৷ বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ বলেছেন, গান্ধীজির পর এই প্রথম কোনো নেতা দেশের পশ্চাদপদ শ্রেণির মানুষের সেবায় এভাবে নিজেকে সমর্পণ করলেন৷
‘জনতার আবেগে সুড়সুড়ি দেয়ার চেষ্টা'
তবে বিরোধীরা তীব্র কটাক্ষ করছেন মোদীর এই কাজের৷ পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র এটাকে নির্বাচনের কর্মসূচি বলেই মনে করছেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এটা একেবারেই ভোটকেন্দ্রিক প্রয়াস৷ ভোটের বাইরে কাজ নেই প্রধানমন্ত্রীর, তাই এসব করছেন৷ দলিতদের মন জয় করতে চাইছেন৷ তবে তাতে লাভ হবে না৷''
প্রবীণ এই কংগ্রেস নেতার ব্যাখ্যা, ‘‘গতবার যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন, তার একটাও পূরণ করতে পারেননি মোদী৷ এটা মানুষ ধরে ফেলেছে৷ সে কথা বুঝতে পেরে প্রধানমন্ত্রী নানা নতুন কৌশল নিচ্ছেন৷ এটা দেশের জনতার আবেগে সুড়সুড়ি দেয়ার চেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়৷''
দেশ জুড়ে বিজেপির প্রধান বিরোধী কংগ্রেস৷ তাদের কেন্দ্রীয় নেতা পবন খেরা প্রশ্ন তুলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর যে দায়িত্ব পালন করা উচিত, তা কেন মোদী করেন না? দাদরিতে গোমাংস রাখার দায়ে সংখ্যালঘু হত্যা, পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলা, কাশ্মীরি ছাত্রদের উপর আক্রমণের পর কেন নীরব থাকেন মোদী?
জাতীয় স্তরে কংগ্রেস নরেন্দ্র মোদীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও পশ্চিমবঙ্গে সেই জায়গায় রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের মন্ত্রী সাধন পাণ্ডেও এটাকে ভোটের চমক বলে ব্যাখ্যা করেছেন৷ এই প্রবীণ তৃণমূল নেতা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী প্রচার ভালোবাসেন৷ স্নান করে তাই সাফাইকর্মীদের পা ধুয়ে দিয়েছেন৷ মোদীর শাসনে গত চার-পাঁচ বছরে দলিতরা খুব সংকটে রয়েছে৷ সেটা তারা ভুলে যাবে না৷ পা ধুয়ে দিলেও এই সমাজের সমর্থন বিজেপি পাবে না৷''
উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, দলিত নেত্রী মায়াবতীর সঙ্গে সহমত পোষণ করে সাধন পাণ্ডে বলেন, ‘‘বিজেপি উচ্চবর্ণের দল বলে পরিচিত৷ ওরা দলিতদের হিতাকাক্ষ্মী নয়৷ চমক দিয়ে এই ভাবমূর্তি বদল করা যাবে না৷''
‘ভোটের পর উনি মাথায় পা রেখে চলবেন'
বামপন্থিদের শক্তি গত কয়েক বছরে অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে রাজ্য ও দেশে৷ তবু রাজনৈতিক অবস্থানের নিরিখে তারা বরাবরই বিজেপির কঠোর সমালোচক৷ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী মোদীর কাজকে তীব্র কটাক্ষ করেছেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘ভোটের আগে পা ধুয়ে দেয়া মানে ভোটের পর উনি সাফাইকর্মীদের মাথায় পা রেখে চলবেন৷ এখন দেখাতে চাইবেন তিনি দলিতের বন্ধু, কিন্তু নির্বাচনের পর শিল্পপতি আদানি, আম্বানিরা হবেন ওঁর সঙ্গী৷''
বিজেপি নেতৃত্ব দাবি করছেন, প্রধানমন্ত্রী সাফাইকর্মীদের পা ধুয়ে এক মহান বার্তা দিতে চেয়েছেন দেশবাসীকে৷ সমাজে এখনও যে অস্পৃশ্যতা, ভেদাভেদের বিষ আছে, তা দূর করবে দেশের শীর্ষ নেতার এই চেষ্টা৷
এই দাবি খারিজ করে দিয়ে সুজন বলেন, ‘‘দলিতদের প্রয়োজন না মিটিয়ে এই বার্তা দেয়া মূল্যহীন৷ পিছিয়ে থাকা এসব মানুষের দাবি, সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি, ১৮ হাজার টাকা ন্যূনতম মাসিক বেতন, উন্নততর জীবনযাত্রা৷ এই দাবি পূরণের জন্য ওঁর সরকার কী করেছে?''
দলিতদের প্রতিক্রিয়া
এ ব্যাপারে কী বলছেন দলিতরা? পশ্চিমবঙ্গের দলিত ও সংখ্যালঘু উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি রাজু ঘোষ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ভোটের আগে এটা একটা মার্কেটিং কনসেপ্ট৷ আমরা এটা মানি না৷ এখন দলিতদের পা ধুয়ে মোদী বোঝাতে চাইছেন, সংখ্যালঘু, দলিতরা সবাই সমান৷ কিন্তু এখন তো অত্যাচার আগের থেকে বেশি হচ্ছে৷ কৃষকরা অত্যাচারিত হচ্ছেন৷ বিভিন্নভাবে প্রতারিত হচ্ছেন দলিতরা৷ দলিতদের জন্য সংরক্ষিত আসন উচ্চবর্ণের কাছে মোটা টাকায় বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে৷''
রাজুর দাবি, দেশের স্বার্থে শহিদ হওয়া দলিত জওয়ানকে যে দেশে উচ্চবর্ণের লোকেরা শেষকৃত্যের জন্য জায়গা দেয়নি, সেখানে প্রধানমন্ত্রী পা ধুইয়ে কী প্রমাণ করতে চান? তাঁর মতে, শুধু বিজেপি নয়, কোনো দলই দলিতদের স্বার্থ দেখেনি৷
নরেন্দ্র মোদীরডাকে স্বচ্ছ ভারত অভিযান চলছে সারা দেশে৷ তাই সাফাইকর্মীদের গুরুত্ব বাড়ারই কথা৷ দমদম এলাকার সাফাইকর্মী দীনেশ মাহারা, রামু প্রামানিকের জীবনে অবশ্য বড় কোনো বদল আসেনি৷ তাঁরা বলেন, ‘‘কোনো দলই দলিতদের জন্য কাজ করে না৷ ভোটের আগে অনেক কথা শোনা যায়৷ দলিত বাড়িতে এসে খাওয়ার হিড়িক শুরু হয়৷ ভোট মিটে গেলে আবার একইরকম৷ মোদীর ব্যাপারটাও ভোটে লাভ তোলার চেষ্টা৷''
এই সুরেই মহিলা সাফাইকর্মী ললিতা দেবী বলেন, ‘‘সবচেয়ে বেশি অত্যাচার হয় দলিতদের উপর৷ সব আমলেই তাই৷ তবে প্রধানমন্ত্রী আমাদের মতো কারোর পা ধুয়ে দিচ্ছেন, এটা টিভিতে দেখে ভালোই লেগেছে৷''
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিজেপি প্রাথমিকভাবে উচ্চবর্ণের দল বলে চিহ্নিত হওয়ায় সমাজের সব স্তরের মধ্যে তাদের জনভিত্তি কম৷ ফের একবার প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি পাওয়ার লক্ষ্যে নির্বাচনের মরসুমে নরেন্দ্র মোদী নিজেকে দলিত-দরদী বলে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন৷