সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আইনি ফাঁক পূরণ করে বাল্যবিবাহ কমবে?
২২ অক্টোবর ২০২৪এই আইনের ফাঁক পূরণ করতে কেন্দ্রকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি।
স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ আমলে তৈরি হয়েছিল বাল্যবিবাহ রোধ আইন। সেই আইন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা গুরুত্ব হারায়। এরপর তাতে সংশোধনী আনা হলেও বাল্যবিবাহ রুখে দেয়ার পূর্ণাঙ্গ রক্ষাকবচ মেলেনি। সুপ্রিম কোর্ট তার পর্যবেক্ষণে এই মতপ্রকাশ করেছে।।
সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ
বাল্যবিবাহ রোধে ২০০৬ সালে আইনের সংশোধনী আনা হলেও তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে গিয়েছে। আইনের ফাঁক গলে বাল্যবিবাহ চলছে রাজ্যে রাজ্যে। এ ধরনের অভিযোগ পুলিশের কাছে জমা পড়ে। কিন্তু বাল্যবিবাহ অনেক ক্ষেত্রেই রুখে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
বস্তুত আইনের ফাঁক দিয়ে বাল্যবিবাহ হয়ে চলেছে বিভিন্ন জায়গায়। এই পরিস্থিতিতে লাগাম টানতে আইনের খামতি দূর করার নির্দেশ দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। গত শুক্রবার এই সংক্রান্ত মামলার পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বলে, এই আইনে কিছু ফাঁকফোকর রয়ে গিয়েছে। এগুলি সংশোধন করা প্রয়োজন।
এই বেঞ্চে রয়েছেন বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্র। শুনানির শেষে একটি গাইডলাইন দিয়েছে শীর্ষ আদালত।
বাল্যবিবাহ রোধের আইনের ঠিকঠাক প্রয়োগ করা হচ্ছে না, এই অভিযোগ করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এই মামলার শুনানিতে আদালত তাদের পর্যবেক্ষণ জানিয়েছে। প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, অপ্রাপ্তবয়স্কদের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে করার অধিকারের যুক্তি দেখিয়ে বাল্যবিবাহ রোধ আইন লঙ্ঘন মেনে নেয়া যায় না।
এই প্রসঙ্গে সর্বোচ্চ আদালতের বক্তব্য, বাল্যবিবাহের মাধ্যমে আদতে অপ্রাপ্তবয়স্কের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। সেই কারণে ব্যক্তিগত আইনের ভিত্তিতে বাল্যবিবাহ রোধ আইন ভঙ্গ করা যাবে না।
প্রশাসনের ভূমিকা
২০০৬ সালে পাশ হওয়া সংশোধনীর মূল ভাবনার উল্লেখ করেছে আদালত। শুধু আইন যথেষ্ট নয়, আইন প্রয়োগের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে বলে মত বিচারপতিদের। আদালত বলেছে, প্রশাসনকে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে হবে। বাল্যবিবাহ রোধ আইন লঙ্ঘন করা হলে শাস্তি দিতে হবে দোষীকে। জরিমানাও ধার্য করা যেতে পারে।
আইনের সংশোধনী সত্ত্বেও যে গলদ রয়ে গিয়েছে, সেটা জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তাদের বক্তব্য, ১৯২৯ সালের আইনটির বিভিন্ন ধারা ২০০৬ সালে সংশোধন করা হলেও এখনও কিছু গলদ রয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রের উচিত সেই ফাঁকগুলি মেরামত করা।
অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিয়ে দেয়ার প্রবণতা এখনো অনেকটাই রয়ে গিয়েছে, বিশেষত পিছিয়ে থাকা শ্রেণীর মধ্যে কম বয়সে বিয়ে দেয়ার ঝোঁক বেশি। একইসঙ্গে আর্থিক লেনদেন জড়িয়ে থাকে এই বিয়ের সঙ্গে।
কয়েকটি রাজ্যে বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ায় অসন্তোষ জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। এই সমস্যা সমাধানে কী করা উচিত, সে ব্যাপারে মত দিয়েছেন তিনি। আদালতের বক্তব্য, প্রত্যেক জনগোষ্ঠীকে বাল্যবিবাহ রোধের আইন সম্পর্কে জানাতে হবে। যারা আইন প্রয়োগ করবেন, সেই আধিকারিকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
দেশের প্রান্তিক এলাকাগুলিতে নাবালক ও নাবালিকাদের কাউন্সেলিং করানোর উপর জোর দিয়েছে আদালত। এনিয়ে সার্বিক সচেতনতা গড়ে তুলতে অভিযান চালানোর কথা বলেছে। শুধু আইনের ফাঁক বোজালেই হবে না, প্রশাসনকে অনেক বেশি তৎপর থাকতে হবে বলে মত বিচারপতিদের।
ইউনিসেফের রিপোর্ট
২০২৩ সালে ইউনিসেফের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাল্যবিবাহ বন্ধ করার ক্ষেত্রে ভারত অনেকদূর এগিয়েছে। কিন্তু তাও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ ভারতে হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বের প্রতি তিনজন অপ্রাপ্তবয়স্ক কনের মধ্যে একজন ভারতে। দেশের পাঁচটি রাজ্যে অর্ধেকের বেশি বাল্যবিবাহ হয়। এই পাঁচ রাজ্য হলো উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, মহারাষ্ট্র ও পশ্চিমবঙ্গ। ভারতে ২৩ শতাংশ মেয়ের বিয়ে ১৮ বছরের আগে হয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ত্রিপুরায় ৪০ শতাংশ মেয়ের বিয়ে ১৮ বছর বয়সে পৌঁছানোর আগে হয়।
আইন প্রয়োগে সমস্যা
আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক স্তরে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। রাজ্য শিশু সুরক্ষা আয়োগের চেয়ারপার্সন তুলিকা দাস ডিডাব্লিউকে বলেন, "সুপ্রিম কোর্ট বারবার কমিউনিটি ইনভলভমেন্ট-এর কথা বলেছে। আইনের মধ্যে তারা কি সেরকম কিছু আশা করছে? আমি জানি না। বাস্তবে কাজটা করতে গেলে বেশ অসুবিধা হয়। বাল্যবিয়ে যদি হয়ে যায়, সেটা বাতিলযোগ্য। যাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে, তারা সেটা মানছে কি না, এই ব্যাপারে আবেদন করতে পারে। যদিও
এই বিষয়গুলি খুব পরিষ্কার করে বলা নেই।"
পশ্চিমবঙ্গে বাল্যবিবাহের চিত্র কেমন? তুলিকা বলেন, "অন্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে বাল্যবিবাহের হার কম। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বাল্যবিবাহ হচ্ছে। সব সময় জোরজবরদস্তি করেই বিয়ে দেয়া হচ্ছে, এমনটা নয়। কন্যাশ্রীর মতো সরকারি প্রকল্প বাল্যবিবাহ কিছুটা হলেও আটকাতে পেরেছে।"
অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বাল্যবিবাহ রোধে কাজ করে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সংলাপ-এর প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর ঐন্দ্রিলা সিনহা ডিডাব্লিউকে বলেন, "সুপ্রিম কোর্ট তার পর্যবেক্ষণে বলেছে, বাল্যবিবাহ শুধু নাবালিকার উপর খারাপ প্রভাব ফেলে না। তার সঙ্গীর ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা সমাজের পক্ষে মঙ্গলজনক নয়। তাই আদালত সচেতনতা ছড়িয়ে দিয়ে এর মোকাবিলার কথা বলছে। উপযুক্ত আইনের পাশাপাশি এই চেতনার বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ।"
শুধু আইনি ব্যবস্থা বাল্যবিবাহ রোধ করা কতটা সম্ভব, এ নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যেও সংশয় রয়েছে। আইনজীবী সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় ডিডাব্লিউকে বলেন, "আইনে ফাঁকফোকর অবশ্যই আছে। বাল্যবিবাহ এখনো আইনের চোখে অপরাধ নয়। সামাজিক স্তরে যেটাকে আমরা অপরাধ বলে মনে করছি, পারিবারিক স্তরে বিষয়টিকে সেভাবে দেখা হচ্ছে না। পাত্র ও পাত্রী প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাদের বিয়ের রেজিস্ট্রেশন হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ আইনের চোখে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত না করলে এই গলদ পূরণ করা সম্ভব নয়।"