বাংলাদেশেও সংবিধান-আইন অনুযায়ী তাই। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর নির্ধারিত হওয়া উচিত৷'
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ২৭ ডিসেম্বর ‘জাতীয় সংলাপ-২০২৪' এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, ‘‘ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর নির্ধারিত হওয়া উচিত৷'' তিনি বলেন, ‘‘তরুণরা সংখ্যায়ও বেশি৷ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা আগ্রহী৷ নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার মতামত নেওয়ার জন্য আমি মনে করি ভোটার হওয়ার বয়স১৭ বছর নির্ধারিত হওয়া উচিত৷''
প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্যের পর পুরো বিষয়টি নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে কিংবা কাউকে সুবিধা দিতে এমনটা করা হচ্ছে কী না সেই প্রশ্নও উঠেছে। আবার ১৮ বছর থেকে ১৭ করতে হলে সংবিধান কীভাবে পরিবর্তন করা হবে, নির্বাচন কমিশন কীভাবে কাজটি করবে তা নিয়েও আলোচনা চলছে। কারণ ভোটার নির্ধারণ আইন, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়াসহ মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হওয়ার বয়স সংবিধান দ্বারা নির্ধারিত। কীভাবে সেটি পরিবর্তন করা হবে সেটাই বিরাট প্রশ্ন।
শিশু সনদ অনুযায়ী, ১৮ বছর বছরের নিচে বয়সিদের শিশু এবং এর ওপরের বয়সীদের প্রাপ্ত বয়স্ক হিসেবে গণ্য করা হয়। আন্তর্জাতিক শিশু সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ বাংলাদেশের শিশু আইনেও ১৮ বছরের নিচে সবাইকে শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়। আর সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সি কোনো ব্যক্তি ভোটাধিকারপ্রাপ্ত হবেন না। ভোটার তালিকা আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হলে তবেই কোন ব্যক্তি ভোট দিতে পারবেন। এখন সেটি ১৭ করতে গেলে অনেক জটিলতা। বিশেষ করে এ নিয়ে নানা সন্দেহ অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যের পরদিনেই জাতীয় প্রেসক্লাবের এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘‘প্রধান উপদেষ্টা সরকারের প্রধান নির্বাহী, তিনি বলে দিচ্ছেন, ১৭ বছর হলে ভালো৷ যদি এক বছর কমাতে চান, তাহলে সেটা নির্বাচন কমিশন প্রস্তাব করুক৷ প্রধান উপদেষ্টা যখন বলে দেন, তখন চাপ তৈরি হয় নির্বাচন কমিশনের জন্য৷ আমি মনে করি, এ বিষয়কে এভাবে না বলে, এ নিয়ে অংশীজনের সঙ্গে কথা বলে তার পরে এ বিষয় আনতে পারলে ভালো হতো, কোনো বিতর্কের সৃষ্টি হতো না৷ এখন তো আরও বেশি করে মানুষ আশাহত হয়ে যাবে৷'
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা ভোটারের সর্বনিম্ন বয়স ১৭ বছরের কথা বলেন তাহলে এটা কমিশনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে৷ রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হয়ে এই চাপ দেয়া ঠিক হয়েছে বলে আমি মনে করি না৷''
তবে জামায়াত প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে সমর্থন দিয়েছে। নীলফামারিতে ২৯ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য সমর্থন করে ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘শিশু-কিশোর ও যুবকেরাই আমাদের নতুন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছে। তাই তাদের ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দিয়ে আমরা কিছুটা হলেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আমাদের দায় শোধ করতে পারি।'
আচ্ছা হঠাৎ করে ১৭ বছর বয়সিদের ভোটার করার আলোচনা কেন এলো? পৃথিবীর কোন দেশে ভোটার হওয়ার বয়স কতো সেই তথ্য খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব দেশেই ভোটার হওয়ার নূন্যতম বয়স ১৮। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপ, চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াসহ প্রায় সব দেশেই এই চিত্র। তবে সিঙ্গাপুরে ভোট দেওয়ার বয়স ২১।
নির্বাচন বিষয়ক সংস্থা এসিই ইলেকটোরাল নলেজ নেটওয়ার্কের তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর ২৩৭ টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে ২০৫ টিতেই ভোটার হওয়ার নূন্যতম বয়স ১৮ বছর। বাকি দেশগুলোতে ভোটার হওয়ার নূন্যতম বয়স ২১ আবার ২৫ও আছে। তবে ১৭ যে কোথাও নেই তাই নয়।
উত্তর কোরিয়া, সুদান, ইন্দোনেশিয়া, গ্রীস ও পূর্ব তিমুর এই পাঁচটি দেশে ভোটার হওয়ার বয়স ১৭। ইথোওপিয়া, নিকারাগুয়া, ইকুয়েডর, কিউবাসহ ছয় সাতটি দেশে ১৬ বছর বয়সেই ভোট দেওয়া যায়।
প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ উত্তর কোরিয়ার মতো ১৭ বছর বয়সীদের ভোটার করলে ইথোওপিয়ার মতো ১৬ বছর বয়সীরা কেন ভোটার হবে না? কোন বিবেচনায় ১৭ বছরে ভোটার আবার ১৬ বছরে নয়? নাকি হুট করেই প্রধান উপদেষ্টা এমন প্রস্তাব দিয়েছেন। এটি হলে ভোটে তারুণ্যরে প্রভাব বাড়বে কোন সন্দেহ নেই।
সর্বশেষে হালনাগাদ খসড়া ভোটার তালিকা অনুযায়ী, এখন দেশের মোট ভোটার ১২ কোটি ৩৬ লাখ ৮৩ হাজার ৫১২ জন। এর আগে ২০২৪ সালের ২ মার্চ চূড়ান্ত ভোটার ছিল ১২ কোটি ১৮ লাখ ৫০ হাজার ১৬০ জন। অর্থাৎ এক বছরে মোট ১৮ লাখ ৩৩ হাজার ৩৫২ জন নতুন ভোটার এবারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। গতকাল ২ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে হালনাগাদ খসড়া ভোটার তালিকার এই তথ্য প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ২০ জানয়ারি থেকে আবার ভোটার তালিকা হালনাগাদের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হবে। আইন অনুযায়ী চলতি বছর হালনাগাদের যেসব তথ্য সংগ্রহ করা হবে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করে আগামী বছরের ২ জানুয়ারি হালনাগাদ খসড়া ভোটার তালিকা করা হবে। আর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে আগামী বছরের ২ মার্চ।
নির্বাচন কমিশন এখন যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ শুরু করবে তাতে আগের নিয়মে বর্তমান ১৭ বছর বয়সীদের তথ্য সংগ্রহ করা হবে এবং তারা ১৮ বছর হওয়ার ডর ২০২৬ সালে ভোটার হবেন। এখন ১৭ বছর বয়সীদের ভোটার করতে হলে পুরো কাজটি নতুন করে করতে হবে। সেটি করতে হলে আগে আইন সংশোধন করতে হবে। এতে নির্বাচন বিলম্বিত হবে কোন সন্দেহ নেই।
আচ্ছা ১৭ বছর বয়স ঠিক করা হলে কী বিপুল পরিমান ভোটার বাড়বে?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীর সংখ্যা এক কোটি ৬৫ লাখ ৬৭ হাজার ১৫০৷ ১৭ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা আলাদা করে প্রতিবেদনে নেই৷ তবে গড় হিসাবে ১৭ বছর বয়সির সংখ্যা ৩০ লাখের একটু বেশি। সে হিসেবে ভোটারের বয়স ১৭ নির্ধারণ করলে ৩০ লাখের বেশি মানুষ হয়তো ভোটার হওয়ার যোগ্য হবে৷ ২০২৫ সালের শেষদিকে নির্বাচন হলে এই সংখ্যা দ্বিগুন হতে পারে। আরো দেরি করলে আরো ভোটার বাড়তে পারে। এ কারণেই হয়তো কেউ কেউ বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের দল কিংবা জামায়াত ১৭ করার প্রস্তাবকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর প্রস্তাবে বলেছেন, ‘তরুণরা সংখ্যায় বেশি। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা আগ্রহী। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার মতামত নেওয়ার জন্য আমি মনে করি ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর নির্ধারিত হওয়া উচিত।'
কোন সন্দেহ নেই তরুণরা দেশ নিয়ে আগ্রহী। ১৭ বছরে তরুণ-তরুণীরা সাধারণত মাধ্যমিক শেষ করেন। কাজেই ১৭ বছর বয়সে তারা কোন দল বা প্রার্থীকে ভোট দেওয়া যায় সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না এমন নয়। সংকটটা আইনি ও বাস্তবায়নেরর। কারণ শিশুনীতি-অনুযায়ী, ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা কিশোর-কিশোরী হিসেবে গণ্য হবে। এ কারণেই ১৮ বছরের নিচে বিয়ে করা যায় না। এমনকি নিজের সম্পত্তির ওপর আইনি অধিকার মেলে না। এমন পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ বছরের শিশু-কিশোরদের ভোটার করা মানে বড় হিসেবে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া যা অন্য আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে এই প্রস্তাব কার্যকর করতে গেলে সংবিধানসহ অনেক আইনকানুন সংশোধন করতে হবে। সবমিলিয়ে জটিলতা ছাড়া আর কিছুই নয় আর রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে একমত হবে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে বিএনপি।
অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এরই মধ্যে বেশ কিছু সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে, যা ৩ জানুয়ারি সরকারের কাছে জমা দেয়ার কথা। গত কয়েকমাসের অলোচনা থেকে যেটা জানা গেছে, কমিশন 'না ভোট' চালু, দ্বি কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ চালু, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না রাখা, জাতীয় সংসদসহ সব নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে জেলা প্রশাসকদের বদলে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের যুক্ত করা, ভোট বাতিলে ইসির ক্ষমতা বাড়ানো, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল, নির্বাচনি অপরাধের শাস্তিসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্ত করে সংস্কার প্রস্তাবনা দেবে। তবে ১৭ বছর বয়স করার প্রস্তাব তারা দেবেন বলে মনে হয় না।
আর বাকি যেসব প্রস্তাব সংস্কার কমিশন দেবে সেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কতটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে তা নিয়েও শঙ্কা আছে। কারণ 'না' ভোট থকে শুরু করে অনেক বিষয়ে বিএনপির আপত্তি আছে। এর মধ্যে ১৭ বছর করার বয়স কোনভাবেই বিএনপি মানবে বলে মনে হয় না।
তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, সংবিধান সংশোধন করে ১৭ বছর বয়সীদের ভোটার হওয়ার যোগ্যতার বিধান যুক্ত করা হলে নির্বাচন কমিশন সে অনুযায়ী কাজ করবে। ৩০ ডিসেম্বর সকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের সম্মেলন কক্ষে এক মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘সংবিধানে তো বলা আছে ১৮ বছর। আমাদের বিধিবিধান যা আছে ভোটসংক্রান্ত সব ১৮ বছরেই আছে। যদি সংবিধান পরিবর্তন করে ১৭ বছর করা হয় আমরা সেভাবে কাজ করব।'তিনি বলেন, ‘আমরা সংবিধান অনুযায়ী চলি। অন্য কারও দিক নির্দেশনায় চলি না। সংবিধান যেটা বলবে সেভাবে আমরা সেটা পালন করব। সুতরাং সংবিধানে যদি ১৭ বছরে ভোটার হওয়ার যোগ্যতার বিধান করে তাহলে সেভাবেই কাজ করা হবে। ভোটার তালিকা আইনে সংশোধনী আনতে হবে। সবকিছু নির্ধারণ হবে সংবিধানে কী কী সংস্কার আনা হচ্ছে।'
সর্বশেষ নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ ২ জানুয়ারি ইসিতে বলেছেন, '১৭ বছর বয়সে ভোটার নিয়ে আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ব্যক্তিগত মতামত দিয়েছেন। এটা নিয়ে আলোচনা চলছে। যদি ভবিষ্যতে এটা রাজনৈতিক কোনো মতৈক্য হয়, কোন সিদ্ধান্ত আছে যদি সংবিধানে পরিবর্তন আসে আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।'
তবে সব আলোচনা এবং আইন কানুন যেভাবে আছে তাতে এ কথা বলাই যায় ১৭ বছরে ভোটার করার প্রস্তাবটা যতো সহজ বাস্তবায়ন ততোটাই কঠিন। এই কঠিন পথে কী যাবে অন্তবর্তীকালীন এই সরকার?
সেই প্রশ্নের উত্তর হয়তো ২০২৫ সালেই পাওয়া যাবে।