1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘শিশুতোষ' ভোটারের প্রস্তাবে অন্য ফন্দি!

৩ জানুয়ারি ২০২৫

বাংলাদেশে ভোটারের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ থেকে নামিয়ে ১৭ বছর করা উচিত কি অনুচিত – তা নিয়ে একটি বিতর্ক চলছে।

https://p.dw.com/p/4onQi
নির্বাচনের  দিন ঢাকায় একজন ভোটার
নির্বাচন ও রাজনীতিতে তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ বাড়াতে ভোটার এবং সংসদ সদস্য হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স কমানো উচিত বলে মনে করছেন কেউ কেউ ছবি: Arafatul Islam/DW

সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভোটারের সর্বনিম্ন বয়স ১৭ করার প্রস্তাব দেয়ার পর এই বিতর্ক শুরু হয়। তবে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই বিতর্ক নতুন কিছু নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশে ভোটারের সর্বনিম্ন বয়স ১৬ বছর করার দাবি উঠেছে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, ভোটারের সর্বনিম্ন বয়স কমানোর পক্ষে যে যুক্তিগুলো দেয়া হয় বিদ্যমান আইন, বিজ্ঞান, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে তার চেয়ে বিরোধী যুক্তিগুলো অনেক বেশি শক্তিশালী।

সেসব যুক্তি বিবেচনা করলে দেখা যাবে, ভোটারের বয়স কমানোর দাবিগুলো যত না সুলক্ষ্য ও আদর্শভিত্তিক তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক। বিষয়টিকে আমরা এভাবে দেখতে পারি, যখন রাজনীতিতে উপলক্ষ লক্ষ্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা প্রবল হয়, তখন এ ধরনের দাবি উঠতে দেখা যায়। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পরিস্থিতির তুলনা করলে এমন প্রস্তাবের প্রয়াসের হেতু আর এর অসারতা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স আইন দ্বারা স্বীকৃত। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ এবং ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাসের তথ্য মতে, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর। এই দুটি সংস্থার ওয়েব সাইট থেকে যে তথ্য পাওয়া যায়, সেখানে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের ২৩৬টি দেশের মধ্যে মাত্র ১০টি দেশে ১৬ বছর এবং ৬টি দেশে ১৭ বছর বয়সকে ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স হিসেবে গণ্য করা হয়। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর, কিউবা, অস্ট্রিয়া, নিকারাগুয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনিয়া এবং মাল্টাতে ভোটার হওয়ার বয়স ১৬। এর মধ্যে আর্জেন্টিনাতে ১৬ বছর বয়স থেকে ভোট দেয়া গেলেও তা ঐচ্ছিক, সেখানে ১৮ বছর বয়স থেকে ভোটদান বাধ্যতামূলক। বসনিয়াতে শুধুমাত্র চাকরিজীবী হলেই কেবল ১৬ বছর বয়সিরা ভোট দিতে পারেন। হাঙ্গেরিতে সাধারণত ১৮ বছর বয়সিরা ভোট দেওয়ার অধিকার পেলেও ১৬ বছর বয়সের বিবাহিতরা স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। আবার এস্তোনিয়াতে ১৬ বছর বয়সিরা স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন, কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে ১৮ বছর বয়সের আগে তারা ভোট দিতে পারেন না। ইন্দোনেশিয়া, উত্তর কোরিয়া, পূর্ব তিমুর, সুদান ও গ্রিসে ১৭ বছরে পা পড়লেই একজন ভোট দেওয়ার যোগ্য হয়। ইসরায়েলে ১৭ বছর বয়সিরা স্থানীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারলেও জাতীয় নির্বাচনের জন্য এই সর্বনিম্ন বয়সসীমা ১৮।

ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলাদেশের প্রতিবেশী সব দেশেই ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর। এশিয়ায় চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও মালয়েশিয়ায, মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, সিরিয়া ও লিবিয়া, ইউরোপের যুক্তরাজ্য, নরওয়ে, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, ইতালি, স্পেন ও নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র, ক্যানাডা ও অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা মহাদেশের মিসর, উগান্ডা, তিউনিসিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় ভোট দেওয়ার সর্বনিম্ন সীমা ১৮ বছর। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি রাজ্যে এর ব্যতিক্রম রয়েছে। সেগুলোতে ১৭ বছরেও ভোট দেওয়া যায়। জার্মানির কয়েকটি প্রদেশের পাশাপাশি পৌরসভা নির্বাচনেও ১৬ বছর বয়সিরা ভোট দিতে পারে। বাকি প্রদেশ ও জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর। এশিয়াতে একমাত্র দক্ষিণ কোরিয়াতে বয়স হলো ১৯ বছর। ক্যামেরুন, তাইওয়ান, বাহরাইন ও নাইরুতে ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ২০ বছর। কুয়েত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, লেবানন ও ওমানে ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়সসীমা হলো ২১। আরব আমিরাতে ভোটার হতে হলে এই বয়স সীমা আরও লম্বা, সেখানে ২৫ বছরের আগে ভোটার করা হয় না।

একটি মৌলিক প্রশ্ন এখানে এসে যায়, সেটি হলো – বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে ভোটারের সর্বনিম্ন বয়স কেন ১৮ বা তার বেশি। ভোটারের সর্বনিম্ন বয়স নির্ধারণ নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে বিতর্ক তা গবেষক মহলেও ছড়িয়েছে। বিশ্বের খুব অল্পসংখ্যক দেশে আমরা দেখতে পাই ১৮ বছরের কম বয়সিরা জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন। আবার ভোটের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে আনার পক্ষে অনেকে যুক্তি দেন। তাদের যুক্তি হলো, এর মাধ্যমে একটি দেশ তার ভবিষ্যৎ গঠনে তরুণদের কণ্ঠস্বরের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিতে পারে। এর প্রধান সুবিধা হলো, আরো বেশি সংখ্যক তরুণ নাগরিকের সম্পৃক্ততা বাড়ানো যায়। তরুণদের জীবন ও ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করে এমন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে তরুণদের অংশীদারিত্ব বাড়ানোর সুযোগ বাড়বে। যেমনটা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী  সরকারের প্রধান উপদেষ্টাও যুক্তি দিয়েছেন, "তরুণরা সংখ্যায়ও বেশি। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা আগ্রহী। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার মতামত নেওয়ার জন্য আমি মনে করি, ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর নির্ধারিত হওয়া উচিত।”

এটি বিশ্বব্যাপী যারা ভোটারের বয়স কমাতে চান, তাদের প্রধান যুক্তি। তারা মনে করেন, তরুণদের যত বেশি সক্রিয় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ হয়, ততই গণতন্ত্র বিকশিত হয়। যদি তরুণ নাগরিক, যারা নীতির দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক, পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক পরিণতি বহন করে, তাদের আনুষ্ঠানিক প্রতিনিধিত্বের অভাব থাকে, তবে একটি ‘গণতান্ত্রিক ঘাটতি' দেখা দেয়। জলবায়ু পরিবর্তন, ডিজিটাল প্রশাসন এবং ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশনের মতো সমসাময়িক চ্যালেঞ্জগুলো প্রায়শই কিশোর-কিশোরীদের কাছে আকর্ষণীয় বিষয়। এসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তরুণদের আগে ভোটাধিকার দেওয়ার মাধ্যমে সম্মিলিত নির্বাচনি সিদ্ধান্তগুলোতে অন্তর্নিহিত দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশস্ত করা যায়। যারা ভোটারের বয়স কমানোর পক্ষে, তাদের যুক্তি হলো, রাজনৈতিক অংশগ্রহণের এই স্ব-শক্তিশালীকরণ প্রকৃতি কেবল ব্যক্তিকেই উপকৃত করে না, বরং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈধতাকেও শক্তিশালী করতে পারে। এতে রাজনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারকদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উদ্বেগের বিষয়ে আরো মনযোগ বাড়াবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভোট দেওয়ার বয়স ১৮। দেশটির সংবিধানের ২৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ভোটারের সর্বনিম্ন বয়স ছিল ২১ বছর। ১৮ বছর করার পেছনের ইতিহাস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ের। রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক খসড়া বয়স কমিয়ে ১৮-তে নামিয়ে এনেছিলেন। তখন যেহেতু তরুণদের যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়েছিল, অনেকে যুক্তি দিয়েছিলেন যে তারা যদি তাদের দেশের জন্য লড়াই করার মতো যথেষ্ট বয়স্ক হন তবে তাদেরও ভোট দেওয়ার মতো যথেষ্ট বয়স হওয়া উচিত।

বেশিরভাগ গবেষক মনে করেন, ভোটারের বয়স ১৮ বছরের নিচে হওয়া উচিত নয়। যারা ১৮ বছরের কম বয়সীদের ভোটার করতে আগ্রহী নয় তাদের মধ্যে যে উদ্বেগগুলো কাজ করে, তার একটি হলো, তরুণ ভোটারদের পরিপক্কতা এবং ভোটদানের আচরণ। আপনি মনে করতে পারেন, ১৬ বছর বয়সিরা ভোট দেওয়ার জন্য যথেষ্ট দায়বদ্ধ। কিন্তু এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এবং জটিল বিষয়গুলো বোঝার ক্ষমতা বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের থেকে আলাদা হতে পারে। বাহ্যিক কারণগুলো সহজেই তরুণ ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারে, যারা রাজনৈতিক বিষয়ে পুরোপুরি অবহিত বা জ্ঞাত মতামত না-ও পেতে পারে। এর ফলে না জেনে বা না বুঝে ভোটদানের প্রবণতা বাড়তে পারে। বাংলাদেশে ১৭ বছরের তরুণ কলেজের গণ্ডি পেরোয় না।

আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় তাদের যে জানার জগত সেটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নোট বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। অনেকেই যুক্তি দিতে পারেন যে, গুগলের এই যুগে তরুণদের হাতে যে প্রযুক্তি আছে তার ফলে তারা সবকিছু জেনে যায়। কিন্তু ইতিমধ্যে প্রমাণ হয়ে গেছে যে, যত বেশি প্রযুক্তি তত বেশি তথ্য বিশৃংখলার আশঙ্কা থেকে যায়। ভুল ও অপতথ্যের জগতে তত বেশি বিচরণ ঘটছে আমাদের। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষার কোনো পর্যায়ে গণমাধ্যম সাক্ষরতার পাঠদান হয় না। ফলে প্রযুক্তি ও তথ্যের অপব্যবহারের শিকার হওয়ার সর্বোচ্চ আশঙ্কার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আমাদের তরুণরা। এমন বাস্তবতায়  যত কম বয়সিদের ভোটার করা হবে ততই কম জানা ও ভুল জানা ভোটারের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাবে। এটি আবেগপ্রবণ ভোটারের সংখ্যা বাড়াবে। এমনিতেই বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের দেশগুলোতে শুধু রাজনৈতিক দলের মধ্যে নয়, আমাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসের চর্চা হয় পারিবারিক প্রভাবকেন্দ্রিক। এর দ্বিমুখী প্রভাব বেড়ে যেতে পারে। একটি হলো পারিবারিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রভাবিত হয়ে নতুন ভোটাররা ভোট দিতে পারে। আরেকটি হলো, ভোট দেয়ার বয়স কমানোর ফলে রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে পরিবারের সদস্য, সহকর্মী, বন্ধু ও সম্প্রদায়ের মধ্যে আরো বিভাজন দেখা দিতে পারে। ভোটারের সর্বনিম্ন বয়স সীমা না কমানোর পক্ষে দ্বিতীয় যুক্তি হলো, ভোট দেওয়ার বয়স কমানো হলে এর সম্ভাব্য পরিণতি রাজনীতির বাইরেও বিস্তৃত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, রাজনৈতিক প্রচারণা তরুণ ভোটারদের লক্ষ্যবস্তু করতে পারে, যা মেরুকরণের প্রভাব সৃষ্টি করে। উপরন্তু ভোটদানের বয়স কমানো হলে বর্তমান ভোটদান প্রক্রিয়ায় যৌক্তিক জটিলতা যুক্ত করতে পারে। যেমন অতিরিক্ত ভোটদানের স্থান, ভোটার নিবন্ধন

সংস্থান এবং নতুন বয়সের বন্ধনীর জন্য ভোটদান প্রক্রিয়া সম্পর্কে শিক্ষা।বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ যুক্তিটি বেশ প্রণিধানযোগ্য। বাংলাদেশে ১৭ বছর বয়সীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হলে আইনে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। আন্তর্জাতিক শিশু সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ বাংলাদেশ। এই সনদে ১৮ বছর বছরের নিচে বয়সিদের শিশু এবং এর ওপরের বয়সিদের প্রাপ্ত বয়স্ক হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশে শিশু আইন, ২০১৩ অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে যারা তারা শিশু হিসেবে গণ্য হয়। বাংলাদেশ সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সি কোনো ব্যক্তি ভোট দিতে পারে না। এছাড়া ২০০৯ সালের ভোটার তালিকা আইন অনুযায়ী ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হলে যে কোনো ব্যক্তি ভোট দিতে পারবেন।

তৃতীয় যুক্তি হলো, বয়স কমানো হলেই তরুণদের মধ্যে ভোটদানের প্রবণতা বাড়বে যুক্তিটি ঠিক নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, তরুণ ভোটারদের উপস্থিতি সাধারণত বয়স্কদের তুলনায় কম। আরো কয়েকটি দেশে দেখা গেছে, তরুণ ভোটারদের যুক্ত করা সামগ্রিক ভোটারদের ভোটদানকে হ্রাস করে, কারণ, তারা ভোট দেওয়ার জন্য নিবন্ধন এবং নাগরিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা কম হয়। ২০২০ সালে ‘দ্য ইম্পেক্ট অব লোয়ারিং অব ভোটিং এইজ টু এইটিন ইন মালয়েশিয়া' শিরোনামে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশটিতে ভোটারের সর্বনিম্ন বয়স ২১ থেকে ১৮ করার পর বেশ কিছু ইতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি নেতিবাচক প্রভাবও দেখা গেছে। বিশেষ করে যে হারে ভোটার সংখ্যা বাড়ার প্রত্যাশা করা হয়েছিল সেটি হয়নি। বরং পারিবারিক ও সামাজিক প্রভাবের মাধ্যমে নতুন ভোটাররা প্রভাবিত হওয়ার হার বেশি দেখা গেছে। 

চতুর্থ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি হলো, একজন নাগরিকের ক্রিয়াকলাপ ও দায়িত্বের জন্য আইনি বয়স। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো বাংলাদেশেও এই আইনি বয়স ১৮ থেকে ২১ বছরের মধ্যে সেট করা হয়েছে। যেমন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, সামরিক পরিষেবা ইত্যাদি। এই বয়স সীমাগুলো এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে যে, কোনো ব্যক্তির পরিপক্কতা এবং বয়সের সাথে সাথে পরিণতি সম্পর্কে বোঝাপড়া বৃদ্ধি পায়। ভোট দেয়ার বয়স এর নিচে নামিয়ে আনা হলে এই বয়স-সম্পর্কিত আইনগুলোর পেছনে যুক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে, যার ফলে বিভ্রান্তি এবং আইনের অন্যান্য ক্ষেত্রে সম্ভাব্য পরিবর্তন হতে পারে।

জাতিসংঘের মতে, যদি জাতীয় আইনে অন্য কিছু না থাকে, তাহলে ১৮ বছর বয়সের কম যেকোনো মানবসন্তানই শিশু বলে গণ্য হবে। আমাদের শিশুনীতি-২০১১ অনুযায়ী, ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা কিশোর-কিশোরী গণ্য হবে। শিশুদের কিছু আইনগত অধিকার আছে। শিশুরা কোনো অপরাধে জড়িত থাকলে তার তদন্ত ও বিচার বিশেষ যত্মের সাথে করতে হয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এমন আইনি নির্দেশ দেয়া আছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে যদি ১৭ বছরের কোনো শিশুকে ভোটাধিকার দেয়া হয় তাহলে সেই শিশু যদি ভোটকেন্দ্রে কোনো অপরাধ করে তাহলে রাষ্ট্রের করণীয় কী হবে? শিশুর এই আইনগত অধিকার এবং শিশু বয়সকাল নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে আইনি ব্যাখ্যা তা আসলে হুট করে করা হয়নি। বরং মানসিক বিকাশ সংক্রান্ত নানা গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইন ও  বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে শিশুকালের সর্বোচ্চ বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। মনোবিজ্ঞান এবং স্নায়ুবিজ্ঞানের গবেষণাগুলো বলে যে, বয়ঃসন্ধিকালে মানুষের মস্তিষ্কের উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটে। এক্ষেত্রে দেখা গেছে, ১৮ বছর বয়সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ক্রিটিক্যাল চিন্তাভাবনা এবং জটিল বিষয়গুলো বোঝার সাথে সম্পর্কিত মানসিক দক্ষতাগুলো সাধারণত পরিপক্ক হয়। এ ধরনের মানসিক বিকাশ ছাড়া তরুণদের পক্ষে রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মগুলো বুঝতে, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের মূল্যায়ন করতে ও ব্যালট বাক্সে ঠিক প্রার্থীকে পছন্দ করা সম্ভব নয়।

গ্রাফিতিতে ঐক্যের বাংলাদেশ

সবশেষ যুক্তিটি হলো, এর রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব। স্থানীয় কিংবা জাতীয়, প্রতিটি নির্বাচনে প্রতিটি ভোট খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে ‘উইনারস টেক অল' নীতিতে ভোট হয়ে থাকে। এখানে তরুণ ভোটারদের অন্তর্ভুক্ত করা হলে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সারাদেশে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সের জনসংখ্যা হলো এক কোটি ৬৫ লাখ ৬৭ হাজার ১৫০। তবে ১৭ বছর বয়সি জনসংখ্যার ঠিক সংখ্যাটি বিবিএস'র তথ্য ব্যাঙ্কে আমরা পাই না। কিন্তু গড় হিসাব থেকে একটি পরিসংখ্যান আমরা পেতে পারি। গড় হিসাবে ১৭ বছর বয়সির সংখ্যা ৩৩ লাখ ১৩ হাজার ৪৩০। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৯৩৭। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ১০ কোটি ৪১ লাখ ৪২ হাজার ৩৮১ জন। অর্থাৎ পাঁচ বছরে ভোটার বেড়েছে এক কোটি ৫৫ লাখ ৪৯ হাজার ৫৫৬ জন। বছরের হিসবে যেটি দাঁড়ায় ৩১ লাখের একটু বেশি। সে হিসেবে ১৭ বছর বয়সীদের ভোটার করা হলে প্রায় এক কোটি বেশি ভোটার যোগ হবে। জামায়াতে ইসলামী ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক দল যে ভোটারের বয়স ১৭ বছরের পক্ষে নয়, তার মূলে আছে ভোটব্যাংকের এই রাজনৈতিক হিসাব।  বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর এই চিন্তা অমূলক নয়। কারণ, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভোটারের বয়স কমানো হলে সেটি রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ১৮ বছরের কম বয়সিদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পৃক্ততা ও অংশগ্রহণের একটি বিশেষ গুরুত্ব আছে। কিন্তু সেটি নানাভাবে করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও সচেতনতা বাড়ানো আর ভোটে ওয়েল ইনফর্মড বা জ্ঞাত এবং শিক্ষিত ভোটারের সংখ্যা এক বিষয় নয়। ভোটারের সংখ্যা বাড়লেই গণতান্ত্রিক আদর্শ সমুন্নত হবে এবং তরুণদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও ইতিবাচক অংশগ্রহণ বাড়বে- এটি প্রমাণিত হয়নি। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এর বিপরীত ফলাফলই এসেছে। বাংলাদেশের মতো যেসব দেশে রাজনৈতিক সুশিক্ষা ও ব্যষ্টিক পর্যায়ে গণতান্ত্রিক চর্চার আকাল আছে, সেসব দেশে শিশুতোষ ভোটারের সংখ্যা বাড়ানো ইতিবাচক ফল আনতে পারে না। কথায় আছে, ‘‘কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস।'' এ কারণে ১৮ বছরের কম বয়সিদের ভোটার করার আগে জরুরি হলো তাদের রাজনৈতিক ও গণমাধ্যম সাক্ষরতা বাড়ানো। না হলে অন্য তরুণদের মতো তারাও ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহৃত হবে, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের ভোট তেমন কোনো অবদানই রাখতে পারবে না।