1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা : দায়ভার আমা‌দের সবার

রিদওয়ান আক্রাম
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

আমার বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। অনেকদিন পর্যন্ত এই পরিচয়ের কোনো মানে ছিল না আমার কাছে,

https://p.dw.com/p/4od5w
Bangladesch | 49. Jahrestag Bangladesch-Krieg
ছবি: bdnews24.com

কেননা, আমার জন্য আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবার পরিচয় ছিল শুধুই ‘বাবা'।  সেই পরিচয়ের বাইরে গিয়ে ‘মুক্তিযোদ্ধা' পরিচয়টুকু সেভাবে বড় হয়ে ওঠেনি অনেকদিন পর্যন্ত।

এমন নয় যে, বাবার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টা আমরা ভাই-বোনেরা জানতাম না৷ এতগুলো বছর পর পেছনে তাকালে মনে হয় বাবার এই ‘মুক্তিযোদ্ধা' পরিচয় সর্ম্পকে আমাদের ভাই-বোনদের যে নিস্পৃহতা সেটার জন্য বোধহয় আমার বাবা স্বয়ং দায়ী। তিনিই আসলে নিজের ‘মুক্তিযোদ্ধা' পরিচয়টুকু নিয়ে সেভাবে সচেতন ছিলেন না, কিংবা সেটাকে বিশাল কিছু ভাবতেন না। সরাসরি কখনো তাঁর কাছে মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোর গল্প শুনিনি। নিজের বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাঁকে বলতে শুনতাম-কীভাবে একাত্তরের আগস্টে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তিনি পৌছেছিলেন ভারতের মহেশখোলা ইয়ুথ ক্যাম্পে।

সেখান থেকে প্রথমে বাগমারা এবং পরে উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় তুরাতে। তাঁর এফএফ নাম্বার ছিল ৯৫৫৬। অস্ত্র প্রশিক্ষণ হয়  ১৫ দিন আর সাত দিন ছিল জঙ্গল ট্রেনিং। গ্রেনেড ছোঁড়া থেকে এসএলআর ও এলএমজি চালানো শেখানো হয়। তবে তিনি পারদর্শী ছিলেন বিস্ফোরকে। যুদ্ধে যাওয়ার আগে তিনি ছিলেন স্কুলের শিক্ষক। বিএসসি টিচার। অংকে বেশ পারদর্শী। আর সেটাই কাজে লেগেছিল তাঁর প্রশিক্ষণে। বাবার বিশেষ দায়িত্বই ছিল শক্রদের রসদ আনা নেওয়ার কাজ ব্যাহত করার জন্য ব্রিজ, কালভার্ট উড়িয়ে দেওয়ার।

প্রশিক্ষণ শেষের দেশে ফিরে যুদ্ধ করেন ১১ নম্বর সেক্টরের নেত্রকোনার মদন, কেন্দুয়া এবং কিশোরগঞ্জের আঠারোবাড়ি, বলাইশিমুল, কাওরাট এবং তাড়াইলের দরিজাহাঙ্গীরপুর, শৈলাহাটি, ধলা প্রভৃতি এলাকা।

একসময় যুদ্ধ শেষ হয়। অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের মতো তিনিও অস্ত্র জমা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন আরেক যুদ্ধে-জীবন যুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুবাদে পেয়েছিলেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চাকরির সুযোগ। সেই সুবিধা না নিয়ে চেয়েছিলেন নিজেই কিছু একটা করতে। আসলে তাঁর কাছে মনে হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ করেছেন শুধুই সময়ের প্রয়োজনে। এখানে কোনো ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার কিছু ছিল না। এমন ভাবনাটা শুধু আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবারই ছিল না, তাঁর মতো অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবনাটাও ছিল তেমন। আর এমন নিঃস্বার্থভাবে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কাজ করে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধারা এখন হচ্ছেন নিগৃহীত। এমনই এক ঘটনা সারা দেশ দেখলো। গত রবিবার (২২ ডিসেম্বর) কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই কানুর প্রতি যা ঘটেছে, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। উপজেলার কুলিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে এই মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেওয়ার ঘটনার দেড় মিনিটের একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, বিশ-পঁচিশজনলোক তাঁকে ঘিরে আছেন এবং কয়েকজন লোক দাবি তোলেন পুরো গ্রামবাসীর কাছে মাফ চেয়ে তাঁকে এলাকা ছাড়তে হবে। কয়েকজন তরুণকে শোনা যায় ‘এলাকা আউট' বলে চিৎকার করতেও। এ সময় কোট পরিহিত এক ব্যক্তি তাঁকে মামলায় তালিকাবদ্ধ করার কথাও বলেন।

রিদওয়ান আক্রাম
রিদওয়ান আক্রাম, সাংবাদিকছবি: DW

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ঘটনাকে ‘জাস্টিফাই' করতে অনেকে এটাও উল্লেখ করেছেন যে, নির্যাতিত বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই হত্যাসহ ৯টি মামলার আসামি।

অথচ স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও বিগত সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই কানু ছিলেন নির্যাতিত। চৌদ্দগ্রামের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের বিপরীতে রাজনীতি করার কারণে গত প্রায় আট বছর এলাকাছাড়া ছিলেন তিনি। তাঁর বাড়িঘরে একাধিকবার হামলা চালিয়েছে মুজিবুলের লোকজন। দেওয়া হয়েছে হত্যাসহ বিভিন্ন মামলা। ৫ আগস্টের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সম্প্রতি তিনি বাড়িতে গিয়েছিলেন। আর তখনই তাঁর সঙ্গে এমন লজ্জাজনক ঘটনাটি ঘটে।

মনে রাখতে হবে এহেন ঘৃণ্য একটি অপরাধকে জাস্টিফাই করলে এই ধরনের অপরাধ আরও বাড়বে। তখন আমাদেরকে উট পাখির মত গর্তে মাথা ঢুকিয়ে রাখা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।

একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পরানো কেন, যে-কোনো মানুষের গলাতেই জুতার মালা পরানোটাই তো অপরাধ। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলোর মধ্যে একটি হলো ব্যক্তির মর্যাদার যথাযথ সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এখন যখন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত একজন মুক্তিযোদ্ধা এভাবে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত হতে পারেন, তখন সাধারণ নাগরিকের মর্যাদা কতটা সুরক্ষিত, তা তো বলাই বাহুল্য।

এটা মনে রাখতে হবে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণি, পেশার মানুষের ওপর হামলা ভিন্ন ভিন্ন বার্তা দেয়। একজন পুলিশের ওপর হামলা একরকম ইঙ্গিত দেয়, একজন রাজনৈতিক কর্মীর ওপর হামলা আরেকরকম প্রস্তাবনা তৈরি করে। ঠিক তেমনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পরানোটার একটা প্রতীকী তাৎপর্য আছে। এটি মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান করার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। দীর্ঘদিনের ক্ষোভ পুষে রাখা এক গোষ্ঠী হয়তো মনে করছে এটাই হয়তো প্রতিশোধ নেওয়ার যথার্থ সময়।

আজকের এমন বাংলাদেশ কারোই প্রত্যাশিত না। বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে এমনভাবে বিভক্ত করা হয়েছে যে, তারা অতি সহজে বলতে পারে-হয় তুমি আমাদের, না হয় ওদের! এসবের মাঝামাঝি কারো যেন কোনো অস্তিত্ব নেই, কোনো কথা নেই। আর স্রোতের বিপরীতে কোনো কথা বললেই বিশেষ কোনো দলের তকমা সে‌টে যাওয়ার ভয় কাজ ক‌রে অনেক মুক্তচিন্তার মানুষদের ম‌নে। আর তাই এখন চুপ থাকাকেই নিরাপদ মনে করছেন অ‌নে‌কে। একাত্তরে যারা জীবন বাজি রেখে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, স্বাধীন দেশে তাদের এমন অপমান ও নির্যাতন কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এটির দায়ভার আসলে কার?

ওই মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের অভিযোগ, লাঞ্ছনাকারীদের সবাই স্থানীয় জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী। কিন্তু ঘটনার শুরু থেকেই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিলেন উপজেলা জামায়াতের নেতারা। তাদের ভাষ্য, যারা ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাদের কেউই জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী নন। প‌রি‌স্থি‌তি সামাল দি‌তেই কিনা নি‌জেদের দুই সমর্থক‌কে ব‌হিষ্কা‌র ক‌রে জামায়াত। প্রশ্ন উঠতে পারে সমর্থকদেরকে বহিষ্কার করা যায় কিনা? বসেছিল না বিএনপিও। একই দিনে তারা এক বিক্ষোভ মিছিল করে বীর মুক্তিযোদ্ধাকে লাঞ্ছনার ঘটনায় জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবি জানায়। তা‌দের বক্তব‌্য ছিল-আমরা কোনো দুষ্কৃতকারী ও আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রতিবাদ করছি না। আমাদের প্রতিবাদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে। যাঁরা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে লাঞ্ছিত করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে।এই মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যদি ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন না করতেন, তাহলে আমরা লাল-সবুজের পতাকা পেতাম না।

বীর মুক্তিযোদ্ধার গলায় যে জুতার মালা স্থান পেল সেটার দায়ভার খানিকটা হলেও গত সরকারকেও নিতে হবে। গত ১৬ বছর ধ‌রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যেভা‌বে নি‌জে‌দের দলীয় প্রডাক্ট বানি‌য়ে‌ছিল, তার দায় অবশ‌্যই আমা‌দের মু‌ক্তিযু‌দ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজ‌নৈ‌তিক দল‌টির। যা কিনা স‌ত্যিই দুঃখজনক। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না।

সব কথার শে‌ষে আবারও বল‌তে চাই, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কোনো প্রকার অসম্মান কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান