সাফাইকর্মীদের নিরাপত্তা কতটা, প্রশ্ন উঠল শীর্ষ আদালতে
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯দেশের ছোট-বড় শহরে যে ভূগর্ভস্থ নিষ্কাশন ব্যবস্থা আছে, তা পরিষ্কার করতে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় সাফাইকর্মীদের৷ একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, জাতি ও বর্ণের ভিত্তিকে প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষ এই কাজের সঙ্গে বংশ পরম্পরায় যুক্ত থাকে৷ এঁদের নিয়ে হঠাৎ কঠোর মন্তব্য করছে শীর্ষ আদালত৷ বিচারপতিরা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘কাজের সময় এই মানুষদের নিরাপত্তা থাকে কি? বিষাক্ত গ্যাসের হাত থেকে তাঁদের বাঁচাতে কোনো রক্ষাকবচ দেওয়া হয়েছে কি?”
তফসিলি জাতি-উপজাতি আইন নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছিল, সেই রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি আদালতের কাছে রেখেছে কেন্দ্রীয় সরকার৷ সেই মামলার শুনানিতে সাফাইকর্মীদের প্রসঙ্গ টেনে সরকারে ভর্ৎসনা করেছে আদালত৷ বিচারপতি অরুণ মিশ্র, বিচারপতি বি আর গাভাই ও বিচারপতি এম আর শাহ-কে নিয়ে গঠিত বেঞ্চ গ্যাস চেম্বারের প্রসঙ্গ টেনে এনেছে৷ পর্যবেক্ষণে ম্যানহোল সাফাইয়ের কাজে যে কর্মীরা যুক্ত রয়েছেন, তাঁদের মাস্ক দেওয়া হয়নি কেন? অক্সিজেন সিলিন্ডারও কেন দেওয়া হয়নি? ম্যানহোলে নেমে আবর্জনা সাফ করতে গিয়ে মাসে চার-পাঁচ জনের মৃত্যু হচ্ছে৷ স্বাধীনতার ৭০ বছর পর এ ধরনের ঘটনা দেশে ঘটছে৷ একে অমানবিক আখ্যা দিয়ে জাতিভেদ নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করে আদালত বলেন, ‘‘সব মানুষই এক৷ কিন্তু, সকলে একই সুবিধা পান না৷’’
কেন্দ্রের তরফে অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে বেণুগোপাল বলেন,‘‘যিনি সাফ করতে নালায় নামছেন, তাঁর দিকে আঙুল তোলা ঠিক নয়৷ যাঁরা এই কাজ করাচ্ছেন, তাঁদের অভিযুক্ত করা উচিত৷’’ কিন্তু, আদৌ কি তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? যদি হয়েই থাকে তবে এখনও অসুরক্ষিত অবস্থায় সাফাইকর্মীরা ভূগর্ভস্থ নিকাশি নালায় নামছেন কেন? খোদ রাজধানী দিল্লির লাজপত নগরের ঘটনা গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল৷ নালায় নেমে আবর্জনা সাফ করতে গিয়ে তিন সাফাইকর্মীর মৃত্যু হয়৷ তাঁদের কাছে অক্সিজেন সিলিন্ডার দূরের কথা, কোনো দড়ি বা মাস্কও ছিল না৷ গুজরাটের বরোদায় ম্যানহোলে নেমে মারা যান সাত জন৷ সরাসরি পুরসভার তত্ত্বাবধানে এই কর্মীরা কাজ করেন না, ঠিকাদার সংস্থা এঁদের দিয়ে কাজ করায়৷ সংস্থার কাছে কর্মীদের সুরক্ষা কোনো গুরুত্বই পায় না৷ উল্টোডাঙার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাফাইকর্মী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘চুক্তির ভিত্তিতে কাজ হয়৷ দড়ি, গ্লাভস, গামবুট এসবের দাবি দিলে কাজ যদি না থাকে, সেই ভয়টা আছেই৷ দড়ি আর বালতি নিয়েই তাই ম্যানহোলে নেমে পড়ি৷ অক্সিজেন তো অনেক দূরের কথা৷ এভাবেই চলে আসছে৷ সরকার থেকে কিছু করা হয় না৷’’
অথচ সাফাইকর্মীদের জন্য নিরাপত্তার জন্য নির্দেশিকা নেই, এমন নয়৷ কিন্তু, তা অনুসরণ করার ব্যাপারে কেউ যত্নশীল নয়৷কেন্দ্রীয় সরকারের সম্প্রতি একটি তথ্য জানিয়েছে, ১৯৯৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৫টি রাজ্যে ৬২০ জনের মৃত্যু হয়েছে ভূগর্ভস্থ নিকাশি নালা সাফ করতে গিয়ে৷ গত তিন বছরে এই সংখ্যা ৮৮৷ পশ্চিমবঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যা ১৮৷ নির্দেশিকা সত্ত্বেও ৮৮টি মৃত্যুর মধ্যে ৫২টি ক্ষেত্রে মৃতের পরিবার ক্ষতিপূরণ পায়নি৷ ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে নির্দেশ দিয়েছিল, ১৯৯৩ সাল থেকে যতজন নিকাশি নালা সাফাইয়ের কাজে নেমে মারা গিয়েছেন, তাঁদের চিহ্নিত করতে হবে৷ মৃতদের পরিবারকে ১০লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে৷ অথচ বাস্তবে তা কার্যকরী হচ্ছে না৷ অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকায় তাঁরা বেশি বঞ্চিত হচ্ছেন৷
সমাজকর্মী সুনন্দা মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ম্যানহোলে প্রবেশ করে কেউ মারা গেলে, তাঁর পরিবার ক্ষতিপূরণ পেতে পারে৷ কিন্তু এঁরা এত পশ্চাদপদ গোষ্ঠীর সদস্য যে, এ সব নিয়মকানুন জানেন না৷ নিজেদের দাবি আদায় করে নেওয়ার ক্ষমতাই তাঁদের নেই৷ তাই বঞ্চিত করা সহজ৷ ‘‘দলিত ও সংখ্যালঘু উন্নয়ন পরিষদের রাজ্য সম্পাদক সনৎ নস্কর বলেন, ‘‘সুরক্ষা বিধি রয়েছে৷ কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গে সেটা পালন করা হয় না৷ জাতিভেদের তকমা দিয়ে অমানবিক কাজ করানো হচ্ছে৷’’