‘গুম’ হওয়া ব্যক্তিদের পরিণতি কী?
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪গুম তদন্তের জন্য গঠিত কমিশনও বলছে, ‘‘গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৭৩ শতাংশ জীবিত ফিরে এসেছেন, তবে ২৭ শতাংশ এখনো নিখোঁজ৷'' এখন পর্যন্ত না ফেরাদের কী হবে তাদের স্বজনরা জানতে চান তারা কি বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন?
ব়্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়ার প্রায় ১৬ মাস পর গত রোববার পরিবারের কাছে ফিরে এসেছেন ঢাকার ধামরাই উপজেলার বড়নালাই গ্রামের রহমত উল্লাহ৷ তার বড় ভাই মো. ওবায়দুল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘আমার ভাই এখন পর্যন্ত যতটুকু বলেছে, তাতে আমরা জানতে পারলাম ভারতের কারাগার থেকে একসঙ্গে ১৪ জনকে সীমান্তে এনে মহানন্দা নদী পার করে দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু অন্য ১৩ জন কারা, সেটা সে বলতে পারেনি৷''
রহমত উল্লাহ ফিরে আসার পর মানবাধিকার সংগঠনগুলো সন্দেহ করছে, ‘গুমে'র শিকার ব্যক্তিদের আরো কেউ ভারতে থাকতে পারে৷ ফলে সরকারের এ ব্যাপারে এখনই আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন৷ অন্য কেউ ভারতে থাকলে তাদের দ্রুত ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে৷
গুম কমিশনের সদস্য, মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কিছু মানুষকে যে বাংলাদেশে ধরার পর ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সে তথ্য আমরা আগেই জানতাম৷ এখন গুম কমিশনে কাজ করতে এসে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে সরাসরি জানতে পারছি৷ এখন আমাদের কমিশনের ম্যান্ডেট তো দেশের মধ্যে৷ আমরা তথ্যগুলো সংগ্রহ করে সরকারকে জানাতে পারি৷ সরকার দেখবে ভারতে কেউ থাকলে তাদের কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায়৷ আবার আমরাও কমিশনের বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিতে পারি, আমরা দেশের সীমানার বাইরে গিয়েও কাজ করবো কিনা? তবে রহমত উল্লাহর ফিরে আসা নতুন কোনো ঘটনা নয়৷ এটা আগের ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতা৷''
কিন্তু ভারতে কেন পাঠানো হয় জানতে চাইলে নূর খান লিটন বলেন, ‘‘আমার মনে হয় তাদেরই ভারতে পাঠানো হয়, যাদের অনেকদিন আটক রাখার পরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় না, অথবা রাজনৈতিক কোনো কারণ আছে, এবং মানুষের ভেতর এটা নিয়ে প্রশ্ন আছে এবং এটা নিয়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যেমন জিডি হয়েছে, প্রেস কনফারেন্স করা হয়েছে ইত্যাদি৷ তখন দীর্ঘসময় পর আর এভাবে না ছেড়ে তাদেরকে ভারতের কোনো সংস্থার হাতে তুলে দেয়া হয়৷ এটা নিয়ে নাটক করা হয়৷ বলা হয় যে, এই লোকগুলো আসলে ভারতে গিয়েছিল, সেখানে আটক হয়েছিল, আমরা আসলে কিছুই জানি না৷''
‘আয়নাঘর' রহস্য
আওয়ামী লীগের শাসনামলে বহুল আলোচিত বিষয় ছিল ‘আয়নাঘর'৷ কাউকে ‘শত্রু' মনে করলেই সেখানে ‘বিনা বিচারে' সরকার তাকে আটকে রাখতো বলে অভিযোগ৷ ‘গুম' হওয়া ব্যক্তিদের অনেককেই আয়নাঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে বলে স্বজনরা ধারণা করেছিলেন৷ ফলে গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পরের দিন, অর্থাৎ ৬ আগস্টই নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা মিরপুরের কচুক্ষেতে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই হেডকোয়ার্টারের সামনে গিয়ে মানববন্ধন করেন৷ তারা আয়নাঘরে বন্দি স্বজনদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান৷
সরকার পরিবর্তনের পর আয়নাঘর থেকে মুক্তি পেয়েছেন তিনজন৷ তারা হলেন, ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমা, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আহমাদ বিন কাসেম (আরমান)৷ এদের মধ্যে রাতে চট্টগ্রামের একটি স্থানে তাকে চোখ-বাঁধা অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয় বলে জানান মাইকেল চাকমা৷ তিনি পাঁচ বছরের উপরে সেখানে বন্দি ছিলেন৷ দীর্ঘ আট বছর পর রাজধানীর দিয়াবাড়ীতে ছেড়ে দেওয়া হয় আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও আহমাদ বিন কাসেমকে৷ সেখান থেকে তারা পরিবারের কাছে ফিরে যান৷
গুম কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন স্থানে আটটি গোপন কারাগারের সন্ধান তারা পেয়েছেন৷ যেগুলো আয়নাঘর বলে পরিচিত৷ এগুলো ডিজিএফআই, ব়্যাব, কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) পরিচালনা করতো৷ এই গোপন কারাগারগুলোতে এখন আর কোনো বন্দি নেই৷ অর্থাৎ, নিখোঁজ থাকা ব্যক্তিদের কেউ সেখানে নেই৷ তাহলে তারা কোথায়, কী অবস্থায় আছেন?
‘গুমে'র শিকার বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদির লুনা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা তো আমাদের স্বজনের পরিণতি জানতে চাই৷ আমার স্বজনের সঙ্গে কী হয়েছে সেটা জানতে চাই? গুম কমিশনের রিপোর্টেও সাধারণ একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে৷ আমরা ওই ধারণা চাই না৷ আমরা সুনির্দিষ্ট করে স্বজন সম্পর্কে তথ্য চাই৷ অন্তত স্বজনের পরিণতি জানলে তো একটা মামলা করতে পারবো৷ কারা এই কাজ করেছে- তাদের চিহ্নিত করে দিলে আমাদের পক্ষে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হয়৷ আমরা রিপোর্টে যেটা দেখলাম তারা শেখ হাসিনা, তারিক সিদ্দিকী, মনিরুল ইসলাম আর হারুণের নাম বলেছে, সেটা তো আমরা আগে থেকেই জানি৷ এটা তো নতুন কিছু না৷ আমরা ব্যক্তি টু ব্যক্তির সম্পর্কের পরিষ্কার ধারণা চাই৷''
গুম কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে যা আছে
প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ ইউনূসের কাছে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দিয়েছে গুম সম্পর্কিত তদন্ত কমিশন৷ সেই প্রতিবেদনের ‘প্রকাশযোগ্য অংশ' হিসেবে ১৭ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন গণমাধ্যমকে সরবরাহ করেছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং৷
গুমের শিকার ব্যক্তিদের নির্যাতনের চিত্র উঠে এসেছে ওই প্রতিবেদনে৷ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাদা পোশাকধারী কয়েকজন ব্যক্তি ধানমন্ডি এলাকা থেকে এক যুবককে তুলে নিয়ে তার ঠোঁট অবশ করা ছাড়াই সেলাই করে দেয়৷ একজন ব্যক্তিকে আটক করে গোপনাঙ্গ এবং কানে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়৷ অন্য আরেকটি ঘটনায় এক ভিকটিম নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে তাকে উদ্ধার করে সেখানেই হত্যা করা হয়৷ এমনকি হত্যার পর সিমেন্টের ব্যাগ বেঁধে লাশ নদীতে ফেলা হয়েছে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গুম করা হয়েছে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীতে৷
একজন সাক্ষী একজন সেনাসদস্যের বরাত দিয়ে কমিশনকে বলেছে, ‘‘একটি লাশ নিয়ে ঢাকার রেললাইনের ওপরে রেখে ট্রেনের অপেক্ষা করতে বলা হয়, যেন ট্রেনের চাপায় লাশটি ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়৷ এমনকি আরেক ভুক্তভোগীকে সড়কে চলন্ত গাড়ির সামনে ফেলে দেওয়া হলেও গাড়িটি পাশ কেটে যাওয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান৷''
কমিশন বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে ১ হাজার ৬৭৬টি জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে৷ এদের মধ্যে কমিশন পর্যালোচনা করেছে ৭৫৮টি অভিযোগ৷ অভিযোগের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ১৩০টি গুমের ঘটনা ঘটেছে এবং ২০২৪ সালে এখন পর্যন্ত ২১টি অভিযোগ জমা পড়েছে৷
প্রতিটি অভিযোগে অন্তত চারটি বৈশিষ্ট্য থাকায় এসব ঘটনাকে গুম হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে কমিশন৷ সেগুলো হলো ভিকটিমের স্বাধীনতা হরণ, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর জড়িত থাকা, ভিকটিমের অবস্থান সম্পর্কে তার পরিবার বা সমাজকে না জানানো এবং ভুক্তভোগীকে কোনো আইনি সুরক্ষা না দেওয়া৷
কমিশন রিপোর্টে বলেছে, সাধারণত ব়্যাব ও ডিজিএফআইয়ের বিভিন্ন স্থাপনায় নির্যাতনের সব বন্দোবস্ত ছিল৷ বিশেষ করে সেনাবাহিনীর পরিচালিত বন্দিশালাগুলোয় নির্যাতনের জন্য বিশেষ যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হতো, যার মধ্যে ছিল সাউন্ড প্রুফ কক্ষ এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের জন্য ডিজাইন করা বিভিন্ন যন্ত্র৷ গুমের শিকার অনেকেই হত্যার শিকার হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছে কমিশন৷
‘গুম'কাণ্ডে ভারতের নাম
গুম কমিশন তাদের রিপোর্টে বলছে, গুমের সঙ্গে ভারতের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে৷ কমিশনের রিপোর্টে সুপ্রিম কোর্ট থেকে অপহৃত সুখরঞ্জন বালি এবং উত্তরা থেকে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদকে গুমের পর ভারতে স্থানাস্থারের ঘটনা এখানে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে৷ তাদের দুই জনকে বাংলাদেশে আটক করা হলেও তাদের সীমান্তের ওপারে পাঠানো হয়৷
এছাড়া বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির প্রয়াত সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হাম্মাম কাদের চৌধুরী তার বন্দিশালায় হিন্দি ভাষাভাষীলোকদের কথা শোনার কথা কমিশনকে জানিয়েছেন৷ তার দাবি মুক্তির সময় তাকে বলা হয়েছিল, ‘‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিচ্ছেন, তবে কিছু শর্ত এখানে রয়েছে৷ আপনাকে অবশ্যই রাজনীতি থেকে বিরত থাকতে হবে এবং দেশ ত্যাগ করতে হবে৷''
সর্বশেষ গত রোববার ভারত থেকে রহমত উল্লাহর ফিরে আসার ঘটনা নিখোঁজ থাকা ব্যক্তির স্বজনদের আশা জাগাচ্ছে৷ পরিবারের কাছে ফিরলেও এখনো স্বাভাবিক হতে পারেননি রহমত উল্লাহ৷ বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকেন তিনি৷ তার বড় ভাই মো. ওবায়দুল্লাহ বলেন, ‘‘গত বছরের ২৯ আগস্ট রাতে ব়্যাব পরিচয়ে একটি দল রহমতকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়৷ এরপর থেকে নিখোঁজ ছিল সে৷ শনিবার দুপুরে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসে৷ অপর প্রান্তের ব্যক্তি নিজেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানার রহনপুর পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের এসআই (উপপরিদর্শক) মো. ফজলে বারী পরিচয় দিয়ে রহমত উল্লাহকে পাওয়ার কথা জানান৷ কল পেয়ে আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জে যাই, সেখান থেকে রহমতকে নিয়ে বাসায় আসি৷ শুরুতে রহমত আমাকে চিনতে পারছিল না৷''
গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর প্ল্যাটফর্ম ‘মায়ের ডাক' এর সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখন তো ভারত থেকে একজন ফেরত এল, ফলে আমরাও স্বজনদের পরিণতি জানতে চাই৷ ভারতে যদি আরও কেউ থাকেন, তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করুক সরকার৷ আমাদের জানা দরকার, আমাদের স্বজনদের সঙ্গে কী হয়েছে? এরপর আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় যাব৷ আমাদের চাওয়া প্রথম থেকে একই, চিহ্নিতকরণ৷ আমরা এতদিন ধরে অপেক্ষা করছি৷ আমাদের তো চিহ্নিত করে বলে দিতে হবে, এই পরিবারের এই সদস্যের সঙ্গে এটা হয়েছে৷ কমিশনের প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে, চিহ্নিত করে পরিবারকে জানানো যে, তাদের স্বজনের সঙ্গে কী হয়েছে? অন্তত ১০টি ঘটনায় যদি তারা সেভাবে রিপোর্ট তৈরি করে দিতেন তাহলে পরবর্তী ১০০ জন অপেক্ষা করতেন৷''
রহমত উল্লাহর সঙ্গে যা ঘটেছে
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খাইরুল বাসার বলেন, ‘‘থানায় আসার পর রহমত উল্লাহ আমাদের বলেছে, গত বছরের ২৯ আগস্ট নিজ বাড়ি থেকে ব়্যাব তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল৷ সে নাকি জঙ্গি সংগঠনের সদস্য এমন সন্দেহে ধরা হয়৷ এরপর ঢাকায় ৯ মাস চোখ, হাত-পা বেঁধে আটকে রাখা হয়৷ যেখানে তাকে রাখা হয়েছিল, এর আশপাশে বিমান ওঠানামা করত৷ শুধু খাওয়ার সময় চোখ খোলা রাখা হতো৷ খাওয়া শেষ হলে আবার তার চোখ বেঁধে ফেলা হতো৷ এভাবে ৯ মাসের মতো রাখার পর গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন হাইয়েস মাইক্রোবাসে করে তাকে যশোরের বেনাপোল সীমান্তে নিয়ে যায়৷ সীমান্ত পার করে রহমত উল্লাহকে ভারতের সীমানায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়৷ দু-তিন দিন ভারতে ঘুরার পর ভারতের পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে৷ অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে ভারতে তাকে একটি জেলে রাখা হয়৷ সেখানে ছয় মাসের সাজা হয়৷ এছাড়া এক হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও দুই মাস জেল খাটতে হবে, এমন সাজা হয়৷ সাত মাস জেল খাটার পর সর্বশেষ দমদম জেলখানা থেকে গাড়িতে করে সীমান্তে আনা হয়৷ গত শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে নৌকা করে রহমত উল্লাহকে নদী পার করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে৷''
মো. ওবায়দুল্লাহ বলেন, ‘‘রহমত আমাকে জানিয়েছে, একসঙ্গে তারা ১৪ জন ভারত থেকে এসেছে৷ ১৩ জন তাদের মতো চলে গেলেও রহমতকে তারা সঙ্গে নেয়নি৷ ওই ১৩ জনের কেউ খুলনা, কেউ যশোরে তাদের বাড়ি বলে জানিয়েছে৷ এদের সম্পর্কে রহমত আর বেশি কিছু বলতে পারেনি৷ অবশ্য এখন বলার মতো অবস্থায় সে নেই৷''
‘গুমে'র শিকার আরো মানুষ ভারতে বন্দি: অধিকার
রহমত উল্লাহ ভারত থেকে ফিরে আসায় গুমের শিকার আরো মানুষ ভারতে বন্দি আছেন বলে ধারণা করছে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার৷ সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২০১২ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকার আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল চত্বর থেকে ডিবি পুলিশ দ্বারা অপহৃত হন সুখরঞ্জন বালি৷ পরবর্তী সময়ে তাকে ভারতের দমদম কারাগারে পাওয়া যায়৷ এছাড়া বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমদ ২০১৫ সালের ১০ মার্চ ঢাকা থেকে গুম হন৷ পরে ওই বছরের ১১ মে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ে তার আটকের খবর পাওয়া যায়৷
এক বিজ্ঞপ্তিতে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন অধিকার জানিয়েছে, রহমত উল্লাহকে ভারত থেকে ফিরে পাওয়ায় গুমের শিকার আরও মানুষ ভারতে বন্দি আছেন বলে তারা ধারণা করছেন৷ অধিকারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং এ সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল৷ বাংলাদেশ থেকে গুম করে ভারতে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো সেটাই প্রমাণ করে৷ অধিকার মনে করে, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারতের কারাগারে বন্দি সব বাংলাদেশিদের তথ্য যাচাই করা প্রয়োজন৷ গুমের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের দাবি, গুমের শিকার ব্যক্তি ও পরিবারকে ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থার দাবি করা হয়েছে৷
অধিকার এর পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা যে ধারণা করছি, সেটার তো প্রমাণ হলো৷ আগের একাধিক ঘটনার সঙ্গে রহমত উল্লাহর ফিরে আসা নিশ্চিত করে ভারতে আরও মানুষ বন্দি আছে৷ এখন যারা ভারতে আছে তাদের উদ্ধার করে পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়ার দাবিও করছি আমরা৷''
এখনো চলছে ‘গুম'?
নিখোঁজের চারদিন পর গত মঙ্গলবার রাতে উদ্ধার হয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সহ-সমন্বয়ক খালেদ হাসান৷ খালেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী৷
খালেদ উদ্ধারের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদের মঙ্গলবার মধ্যরাতে সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘খালেদ ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারছেন না৷ আমি তার সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চাইলে সে আমাকে তার গুম হওয়ার ঘটনা জানায়৷ খালেদের ভাষ্যমতে, শুক্রবার বিকালের দিকে টিএসসি থেকে রিকশায় করে দোয়েল চত্বরের দিকে যাবার সময় রিকশাতেই তিনি জ্ঞান হারান৷ পরবর্তীতে তিনি যখন জ্ঞান ফিরে পান নিজেকে সুনামগঞ্জের একটি পেট্টোল পাম্পের কাছে মাইক্রোবাসে দেখতে পান৷ এ সময় তার সঙ্গে আরও ২-৩ জন ছিল৷ পরবর্তীতে তিনি ফের জ্ঞান হারান৷ দ্বিতীয়বার যখন খালেদ জ্ঞান ফিরে পান তখন নিজেকে পঞ্চগড়ের কোনো একটা জায়গায় দেখতে পান৷ তখনও মাইক্রোবাস চলমান ছিল৷ তৃতীয়বার মঙ্গলবার যখন তার জ্ঞান ফিরে আসে, তখন তিনি নিজেকে বরিশালের এক রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখেন৷ পরে তাকে কেউ একজন গাড়িতে তুলে দিলে ঢাকায় পৌঁছে হলে ফিরে আসেন৷''
বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও গুমের এমন অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘খালেদ আসলে গুম হয়েছিলেন কিনা সেটা এখনো আমরা নিশ্চিত নই৷ পারিবারিক কারণেও তিনি নিখোঁজ থাকতে পারেন৷ খালেদ সুস্থ হলেই পুরো পরিস্থিতি জানা যাবে৷''
খালেদ নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই তার সন্ধানে ছোটাছুটি করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হামজা মাহবুব৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘খালেদ যে গুম হয়েছিলেন, সে বিষয়ে আমরা এখনো নিশ্চিত নই৷ আব্দুল কাদের হয়ত তাৎক্ষণিকভাবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ‘গুমে'র কথা বলেছেন৷ এটাকে এখনই আমরা চূড়ান্ত বলে মনে করছি না৷ আমরা চাই খালেদ সুস্থ হয়ে মিডিয়ার সামনে তার নিখোঁজ থাকার বিষয়টি পরিষ্কার করবেন৷''