জনসমুদ্রে লুটের অস্ত্রধারী ও জেল পালানো জঙ্গি, আসামি
১২ ডিসেম্বর ২০২৪জেল পালানো সাত শতাধিক বন্দিও বাড়াচ্ছে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা৷ পলাতকদের মধ্যে ৮০ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, ৭৮ জন জঙ্গি৷
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন দায়িত্বরত স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ)-এর সদস্যরা ভল্টে অস্ত্র জমা রেখে গণভবন ছেড়ে যান৷ পরে অভ্যুত্থানকারীরা গণভবনে ঢুকে পড়লে এক পর্যায়ে ভল্টে রাখা ৩২টি অত্যাধুনিক অস্ত্র লুট হয়ে যায়৷ এর মধ্যে অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, এসএমজি টি-৫৬-সহ অত্যাধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে৷ সেগুলোসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় দেড় হাজার আগ্নেয়াস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি৷ বিভিন্ন কারাগার ভেঙে পালিয়ে যাওয়া ৭৮ জঙ্গিসহ ৭ শতাধিক বন্দিও এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে৷ পলাতক বন্দিদের মধ্যে ৮০ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীও আছেন৷
লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং জেল-পালানো জঙ্গিদের কারণে নিরাপত্তা সংকট বাড়ছে কিনা জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব) আ ন ম মুনীরুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ এখন যে উদ্ধার হয়নি, সেটা তো উদ্বেগের৷ এছাড়া গণভবন ও সংসদ ভবন থেকে এসএসএফের যে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়েছে, সেগুলো তো কোনোভাবেই সাধারণ নাগরিকের কাছে, এমনকি পুলিশের কাছে থাকাও উচিত নয়৷ এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাইরে থাকলে যে-কোনো সময় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা থেকে যায়৷ আবার সব অস্ত্রই যে দেশে থাকবে এমনও নয়৷ এগুলো পাচারও হতে পারে৷’’
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ওই সময় পুলিশ, বিভিন্ন থানা, কারাগার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পাঁচ হাজার ৮২৯টি অস্ত্র এবং ছয় লাখ ছয় হাজার ৭৪২টি গুলি লুট হয়৷ এর মধ্যে ১ হাজার ৫৪৬টি আগ্নেয়াস্ত্র, ২ লাখ ৬২ হাজার গোলাবারুদ উদ্ধার করা যায়নি। সেপ্টেম্বরের শুরুতে শেষ হওয়া সাধারণ ক্ষমার সময় ৩ হাজার ৭০০ টি অস্ত্র জমা পড়েছিল৷ তবে গত নভেম্বরে যৌথবাহিনীর পক্ষে কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন, যৌথবাহিনীর অভিযানে ৬ হাজারের মতো অবৈধভাবে রাখা আগ্নেয়াস্ত্র এবং ২ লাখ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে৷ অভিযান এখনো চলছে৷ অভিযানে সেনাবাহিনীর হেফাজতে চারজনের মৃত্যুর খবর প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘সেনারা কঠোরভাবে নিয়ম মেনে চলছে৷ তারপরও যদি কোনো অভিযোগ আসে, আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো৷’’
লুটের অস্ত্রে তরুণীকে হত্যা, চাঁদাবাজি
গত শনিবার মুন্সীগঞ্জের বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়েতে তরুণীর গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের ঘটনায় তৌহিদ শেখ তন্ময় (২৮) নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ ওই যুবক পুলিশকে জানায়, বিয়ের জন্য চাপ দেওয়ায় তরুণীকে হত্যা করেছে সে৷ যে অস্ত্র দিয়ে গুলি করা হয়, সেটি গত ৫ আগস্ট ঢাকার ওয়ারী থানা থেকে লুট করা৷ তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের একটি পুকুরে তল্লাশি চালিয়ে ওই অস্ত্রটি উদ্ধার করা হয়েছে৷
চট্টগ্রামে লুট করা অস্ত্র দিয়ে চাঁদাবাজি করার সময় একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ ঢাকার বিহারী ক্যাম্পে মাদক কারবারিদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময়ও থানা থেকে লুট করা অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে বলে জানা গেছে৷
এসব ভারী আগ্নেয়াস্ত্র সাধারণ মানুষের কাছে থাকার ঝুঁকি সম্পর্কে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অবৈধ কোনো আগ্নেয়াস্ত্র সাধারণ মানুষের কাছে থাকা ঠিক না৷ এর কারণে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে-কোনো সময় অবনতি হতে পারে৷ এই মুহূর্তে সরকারের কাজ হবে এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে মনোযোগ দেওয়া৷ পাশাপাশি যেসব সন্ত্রাসী ও জঙ্গিরা পালিয়ে গেছেন, তাদের গ্রেফতার করতে হবে৷ এ কাজে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়াতে হবে৷’’
গণভবন থেকে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ)-এর লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদের মধ্যে আছে, অত্যাধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, এসএমজি টি-৫৬, ফ্ল্যাশব্যাং গ্রেনেড, অ্যান্টি-ড্রোন সিস্টেম, বেতার যোগাযোগের ডিভাইস ও বিপুল গোলাবারুদ৷ এগুলো সবই ভারী আগ্নেয়াস্ত্র বলে পরিচিত৷
জেল পালানো ৭৮ জঙ্গি কোথায়?
জেল থেকে পালানো ৭৮ জন জঙ্গি এখনো গ্রেপ্তার হয়নি৷ গত ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সারাদেশের ৮টি কারাগারে কয়েদী ও হাজতীরা বিদ্রোহ করে৷ তাদের মধ্যে ৮৮ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিও পালিয়ে যায়৷ পলাতক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ৮ জন পুলিশ ও র্যাবের হাতে ধরা পড়ে৷ বাকি ৮০ জন এখন ফেরারী৷ জঙ্গি আসামীদের মধ্যে কাশিমপুর কারাগার থেকে শতাধিক জঙ্গি আসামী পালিয়ে যায়৷ এর মধ্যে এখনো ৭৮ জন অধরা রয়েছেন৷
গত ৬ আগষ্ট সকালে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি জেলে কয়েদিদের মধ্যে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে৷ কয়েদিরা কারা অভ্যন্তরে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও লুটপাট চালিয়ে মোট ১৯৯ জন পালিয়ে যায়৷ এর মধ্যে ৮৮ জন রয়েছেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি৷ এর মধ্যে ২০৩ জন আসামি ছিলেন যারা নরসিংদী কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর আত্মসমর্পন করেন, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন পালিয়ে যান৷ তবে কাশিমপুর কারাগারে দেশের অন্যান্য কারাগার থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের এই কারাগারে রাখা হয়৷ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সকল আসামি পালিয়ে যায়৷ পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে পুলিশ ও র্যাবের হাতে ৮ জন আসামি গ্রেপ্তার হন৷
কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন্স ) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন বলেছেন, কারাগারগুলো থেকে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন, বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত বন্দিসহ বিচারাধীন মামলার ২ হাজার ২০০ বন্দি পালিয়ে যায়, যার মধ্যে ১ হাজার ৫০০ জনকে গ্রেপ্তারের পর ফের কারাবন্দি করা হলেও এখনো ৭০০ বন্দি পলাতক রয়েছে৷ ওই সময়ে আটটি কারাগার থেকে অস্ত্র লুট হয়েছিল ৯৪টি৷ এর মধ্যে ৬৫টি উদ্ধার করা হয়েছে৷ বর্তমানে দেশের ৬৯টি কারাগারের মধ্যে ১৭টি কারাগার অনেক পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ৷ ৫ আগস্টের আগে বন্দি ছিল ৫৫ হাজার, যদিও পরবর্তীতে সেই সংখ্যা কমে গিয়েছিল৷ এখন বন্দি সংখ্যা ৬৫ হাজার৷
পুলিশের বিশেষ শাখা সূত্র জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে পলাতক ৭শ বন্দির তালিকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও স্থল বন্দরের ইমিগ্রেশন শাখায় দেওয়া হয়েছে৷ এর পাশাপাশি পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির কাছেও তালিকা দেওয়া হয়েছে৷
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সমস্যা এখানে দু'টি৷ প্রথমত, অস্ত্র আর দ্বিতীয়ত, জঙ্গি বা সন্ত্রাসী৷ এখন খোয়া যাওয়া অস্ত্র যদি জঙ্গিদের হাতে যায়, সেটা তো ভয়ঙ্কর ঝুঁকির কারণ৷ শুধু জঙ্গিদের হাতে নয়, যে কোনো অপরাধীর হাতে এসব অস্ত্র গেলে সেটাও নিরাপত্তার জন্য হুমকি৷ কারণ, কোনো সাধারণ মানুষের হাতে তো আর এসব অস্ত্র থাকার কথা নয়৷ যে এটার ব্যবহার করবে সেই দখলে রেখেছে৷ ফলে আরও বেশি মনোযোগ দিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চালাতে হবে৷''
জামিনে ছাড়া পাওয়া অপরাধীরাও তৎপর
জামিনে কারাগার থেকে বের হয়ে এসে আবারও প্রকাশ্যে তৎপরতা শুরু করেছেন কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী৷ পাশাপাশি পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীদেরও বেশ কয়েকজন প্রকাশ্যে এসেছেন৷ ইতিমধ্যে মগবাজারে প্রকাশ্যে মহড়া দিয়েছেন পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন৷ মোহাম্মদপুরে শীর্ষ সন্ত্রাসী আরেক পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালের বিরুদ্ধে দুই যুবককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় মামলা হয়েছে৷ অনেকের নামেই ফোন করে চাঁদা দাবি করা হচ্ছে৷
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন অন্তত ৬ জন শীর্ষ সন্ত্রাসী৷ এদের প্রায় সবাই কমপক্ষে ১৫-২০ বছর ধরে কারাবন্দি ছিলেন৷ খুন, চাঁদাবাজি, ভাংচুর ও দখলবাজির অভিযোগে এদের সবার বিরুদ্ধেই ৭ থেকে ১৫ টি মামলা ছিল৷ সব কটি মামলায় জামিন পাওয়ার পর তারা কারাগার থেকে মুক্তি পান৷ এদের মধ্যে আছেন, পূর্ব রাজাবাজার এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী শেখ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম৷ হাজারীবাগের সানজিদুল ইসলাম ইমন, মিরপুরের আব্বাস উদ্দিন ওরফে কিলার আব্বাস, মোহাম্মদুপরের ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন ও খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু৷ এদের কেউ কেউ স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছেন বলে দাবি করেছেন৷
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একজন মানুষ তো সারাজীবন কারাগারে থাকতে পারে না৷ আদালত যদি জামিন দেয় তাহলে মুক্তিতে সমস্যা কী? জোর করে তো আর তাকে কারাগারে আটকে রাখা যাবে না৷ তবে হ্যাঁ, কারাগার থেকে বের হওয়ার পর তার দিকে নজরদারি অবহ্যত রাখতে হবে৷ তিনি যদি অপরাধ জগৎ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন তো ভালো কথা৷ কিন্তু তিনি যদি আবারও অপরাধ জগতে ফিরে যান তাহলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আবারও তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করবে৷’’