ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ করার আলোচনায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া
২৯ ডিসেম্বর ২০২৪অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২৭ ডিসেম্বর ‘জাতীয় সংলাপ-২০২৪'-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, ‘‘ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর নির্ধারিত হওয়া উচিত৷'' তিনি বলেন, ‘‘তরুণরা সংখ্যায়ও বেশি৷ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা আগ্রহী৷ নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার মতামত নেওয়ার জন্য আমি মনে করি ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর নির্ধারিত হওয়া উচিত৷'' তবে যেকোনো সংস্কারের ব্যাপারে তিনি জাতীয় এবং রাজনৈতিক ঐক্যমতের কথা বলেন৷
তার এমন কথার ব্যাপারে প্রেক্ষিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে৷ রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে, এটি নির্বাচনের আয়োজনের ক্ষেত্রে সময় ক্ষেপণ করবে৷ তাই এই ধরনের সংস্কার নির্বাচিত সরকার করতে পারে৷ আর ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর করার সঙ্গে আরো অনেক বিষয় জড়িত, যেগুলো সংবিধান সংস্কারের সঙ্গে জড়িত৷ বাংলাদেশে ভোটার হওয়া, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়াসহ মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হওয়ার বয়স সংবিধান দ্বারা নির্ধারত৷
অবশ্য সংবিধান সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজ এর আগে বলেন, সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতার বয়স ২৫ থেকে কমিয়ে ২১ বছর নির্ধারণের চিন্তা রয়েছে৷ আলী রিয়াজের এমন বক্তব্যের পর তেমন কোনো রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি৷
তবে প্রধান উপদেষ্টার কথার পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলগীর বলেন, ‘‘এখন তাহলে কী করতে হবে? নতুন করে আবার ভোটার তালিকা তৈরি করতে হবে৷ আমি মনে করি, এ বিষয়কে এভাবে না বলে, এ নিয়ে অংশীজনের সঙ্গে কথা বলে তার পরে এ বিষয় আনতে পারলে ভালো হতো, কোনো বিতর্কের সৃষ্টি হতো না৷ এখন তো আরও বেশি করে মানুষ আশাহত হয়ে যাবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘প্রধান উপদেষ্টা সরকারের প্রধান নির্বাহী, তিনি বলে দিচ্ছেন, ১৭ বছর হলে ভালো৷ যদি এক বছর কমাতে চান, তাহলে সেটা নির্বাচন কমিশন প্রস্তাব করুক৷ প্রধান উপদেষ্টা যখন বলে দেন, তখন চাপ তৈরি হয় নির্বাচন কমিশনের জন্য৷’’
আগামী ৩ জানুয়ারি প্রধার উপদেষ্টার কাছে ‘নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন' প্রতিবেদন জমা দেবে৷ ওই কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘‘আমরা ভোটারদের বয়স নিয়ে কোনো সুপারিশ করছি না৷ এটা আমাদের কাজও নয়৷ সংবিধানেই ভোটারদের বয়স এবং নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বয়স নির্ধারণ করা আছে৷ এব্যাপারে কোনো সুপারিশ থাকলে সংবিধান সংস্কার কমিশনের থাকতে পারে৷’’
বাংলাদেশের সংবিধানে সংসদ সদস্য ২৫ এবং রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য সর্বনিম্ন ৩৫ বছর বয়স হতে হবে৷ আর প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বা অন্যান্য পদের জন্য সংসদ সদস্য হওয়ার বয়স মানে সর্বনিম্ন ২৫ বছর হলেই চলবে৷ ভোটাধিকারের জন্য সর্বনিম্ন ১৮ বছর৷
১৭ বছর হলে ভোটার কত বাড়বে
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীর সংখ্যা এক কোটি ৬৫ লাখ ৬৭ হাজার ১৫০৷ ১৭ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা আলাদা করে প্রতিবেদনে নেই৷ তবে গড় হিসাবে ১৭ বছর বয়সির সংখ্যা ৩৩ লাখ ১৩ হাজার ৪৩০৷
গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৯৩৭৷ একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ১০ কোটি ৪১ লাখ ৪২ হাজার ৩৮১ জন৷ পাঁচ বছরে ভোটার বৃদ্ধি পায় এক কোটি ৫৫ লাখ ৪৯ হাজার ৫৫৬ জন৷ বছরে ভোটার বৃদ্ধি পায় ৩১ লাখের বেশি৷
বিবিএস ও নির্বাচন কমিশনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভোটারের বয়স ১৭ নির্ধারণ করলে ৩০ লাখের বেশি মানুষ ভোটার হওয়ার যোগ্য হবে৷ প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী, ২০২৫ সালের শেষদিকে নির্বাচন হলে দুই বছরে আরও ৬০ লাখের বেশি তরুণ যোগ হবেন ভোটার তালিকায়৷ বয়স কমিয়ে ১৭ করা হলে প্রায় এক কোটি নতুন ভোটার যোগ হবে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে৷
ভোটার হওয়ার বয়স কোন দেশে কেমন
জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সীরা শিশু৷ তাই যেসব দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে, এর অধিকাংশে ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ১৮৷
তবে বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে এবং তথ্যানুসন্ধানে জানা যায় কিছু দেশে ভোটার হওয়ার বয়স ২০ থেকে ২৫ বছর৷ আবার ১৮ বছরেরর কমও আছে৷ ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ বলছে, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় ভোটার হওয়ার বয়স ১৬৷ আর্জেন্টিনায় ১৫ বছর বয়সীরাও প্রার্থী বাছাইয়ে ভোট দিতে পারে, যদি নির্বাচনের সময় ১৬ বছরে উত্তীর্ণ হয়৷ যুক্তরাজ্যের ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, উত্তর আয়ারল্যান্ড ও ওয়েলসে ভোটের বয়স ১৮৷ তবে স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসে প্রাদেশিক ও স্থানীয় নির্বাচনে ১৬ বছর বয়সীরা ভোট দিতে পারে৷ গ্রিস, ইন্দোনেশিয়া, উত্তর কোরিয়া, নেপাল, সুদান, পূর্ব তিমুরে ভোটের বয়স ১৭ বছর৷ বসনিয়া ও সার্বিয়ায় কর্মজীবী হলে ১৬ বছর বয়সীরাও ভোট দিতে পারে৷ কিউবা, ইকুয়েডর, মাল্টায় ভোটের বয়স ১৬৷
রাজনৈতিক দলগুলো কী ভাবছে
ভোটারদের বয়স বাড়ানোর বিসয়ে বিএনপি মূলত সময় ক্ষেপণের দিক নিয়েই বেশি চিন্তিত৷ দলটি মনে করছে, ১৭ বছর করা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া৷ এর সঙ্গে আরো অনেক সংস্কার যুক্ত৷ সেটা হলে তারা যে দ্রুত নির্বাচন চায় সেটা বিলম্বিত হবে৷
সেইসাথে ভোটের হিসাবও করছে তারা৷ কারণ এখনকার যে ভোটের হিসাব, তাতে নির্বাচনে বিএনপির কোনো সংকট বা আশাহত হওয়ার কারণ নেই৷ কিন্তু ১৭ বছর হলে যে এক কোটি নতুন ভোটার হবে তারা কোন দিকে যাবে সে ব্যাপারটি তাদের জন্য ভাবনার৷
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ‘‘এখন ১৭ করা হলে আরেক গ্রুপ বলবে ১৬ বছর কেন নয়? তখন নানা দিক থেকে নানা দাবি উঠবে৷ নানা ধরনের আন্দোলন শুরু হবে, যা একটি বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করবে৷ অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হবে৷ আর তাতে সামনের নির্বাচন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে৷ আমরা সেটা চাই না৷’’
‘‘আর ১৮ বছরের নিচে যারা তাদের তো বাংলাদেশে শিশু মনে করা হয়৷ আমরা শিশুদের ভোটাধিকার দেব কী না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন৷ যদি ১৭ বছর করার প্রয়োজন হয় তাহলে নির্বাচিত সরকার সেটা সংসদে আলোচনা করে দেখতে পারে৷ সংবিধান এবং আইনের সংস্কারের যদি প্রয়োজন হয় সেটা নির্বাচিত সরকার দেখবে৷''
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স মনে করেন, ‘‘নির্বাচনসহ নানা ধরনের সংস্কারের জন্য কতগুলো কমিশন কাজ করছে৷ তারা এখনো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসেনি৷ বসবে কী না জানি না৷ কিন্তু ওই কমিশনের প্রস্তাবের আগেই যদি প্রধান উপদেষ্টা ভোটারের সর্বনিম্ন বয়স ১৭ বছরের কথা বলেন তাহলে এটা কমিশনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে৷ রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হয়ে এই চাপ দেয়া ঠিক হয়েছে বলে আমি মনে করি না৷''
‘‘আসলে ভোটারের বয়স ১৭ করতে হলে আরো অনেক পরিবর্তন লাগবে৷ এটা সময় সাপেক্ষ৷ এখন অনেক নন -ইস্যুকে ইস্যু করে এই সরকারের যে মূল কাজ তা থেকে তারা দূরে সরছে৷ আমাদের দরকার নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণ৷ সংবিধানকে সামনে রেখে সেই দিকে তাদের মনোযোগ দেয়া দরকার বলে আমি মনে করি,'' বলেন তিনি৷
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামির প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘‘ভোটারের বয়স নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা যে ১৭ বছরের কথা বলেছেন সেটা নিয়ে আমরা দলীয়ভাবে আলোচনা করিনি৷ ফলে দলের পক্ষ থেকে কোনো মতামত এখনো দেয়া সম্ভব নয়৷ তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ৷ আগের সময়ের চয়ে ম্যাচিউরিটি এবং সচেতনতা কম বয়সেই আসে৷ ফলে ১৭ বছর বয়সে ভোটার করা যেতে পারে৷''
বিশ্লেষকদের মন্তব্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘‘বিশ্বের কিছু কিছু দেশে ১৭ বছর বা তার কম বয়সেও ভোটাধিকার আছে৷ এটা একেক দেশ একেক প্রেক্ষাপটে করেছে৷ আমাদের দেশে ১৮ থেকে এক বছর কমিয়ে ১৭ হতে পারে বলে আমি মনে করি৷ প্রধান উপদেষ্টা যেটা বলেছেন, আমার বিবেচনায় সেটা হতে পারে৷’’
তার কথা, ‘‘জেন জেড-এর যে ডেফিনেশন তাতে ১৭ বছর বয়সীরা তাদের ভালো মন্দের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন৷ তারা রাজনৈতিব সিদ্ধান্ত নিতেও সক্ষম বলে আমি মনে করি৷ তবে ভোটার হওয়ার বয়স সর্বনিম্ন ১৭ বছর বললেই তো হয়ে যাবে না৷ এটার জন্য সময় লাগবে৷ সংবিধান ও আইনের পরিবর্তন করতে হবে৷''
এদিকে অধ্যাপক ড. জাহেদ উর রহমান বলেন, গ্লোবালি এখন সবাই ১৮ বছরের নিচে শিশু হিসেবে বিবেচিত৷ আমাদের দেশেও আইনে যারা ১৮ বছরের নিচে যারা তাদের শিশু মনে করি৷ তাদের আমরা জেলে নিই না, সংশোধনকেন্দ্রে পাঠাই৷ বাংলাদেশে ভোটার হওয়া বয়স একটু বেশি হওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি৷ কারণ এখানে পলিটিক্যাল ডিনামিকসটা বেশ জটিল৷ আর প্রার্থীর বয়স কমানোর ব্যাপারেও কথা হচ্ছে৷ বড় বড় দেশে আমরা ৩০ বছর বা তার কম বয়সেও প্রধানমন্ত্রী হতে দেখেছি৷ ওইসব দেশে সহজ৷ কারণ সেখানে সব কিছু সিস্টেমেটিক৷ ফলে দেশ চালানো সহজ৷ কিন্তু বাংলাদেশে এত সহজ নয়৷ এখানে সিস্টেমের সমস্যা আছে৷''