ফিরে দেখা ২০২৪ : শাসনের পরিবর্তন, স্বস্তি কতটুকু?
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স প্রায় ৫ মাস হতে চললো। জনগনের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব কি মিলছে? আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্য, বিচারাঙ্গন, মত প্রকাশের স্বাধীনতার অবস্থা কি? কিছু ক্ষেত্রে স্বস্তি মিললেও অস্বস্তি এখনcf অনেক কিছুতেই।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল বিরাজনীতিকরণ ও দুর্নীতি। মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়ার গুরুতর অভিযোগও ছিল। রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ (এ) আওয়ামী লীগের মিত্ররা অনেকটাই নিশ্চুপ। উর্ধ্বতন নেতারা গ্রেপ্তার হয়ে অনেকেই কারাগারে। রাজনীতির মাঠ এখন বিএনপি ও তাদের মিত্ররা এবং জামায়াতকে খুবই সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ, একটি পক্ষ এখন রাজনীতির মাঠে নিষ্ক্রিয়, অন্য পক্ষটি সক্রিয়। এখনো যেহেতু নির্বাচয় হয়নি, ফলে ভোটের অধিকার ফিরেছে এখনই সেটা বলা যাচ্ছে না। ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা আছে।
অর্থনীতির অবস্থা
এবার আসা যাক অর্থনৈতিক সেক্টরে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল অর্থনীতিতে ভঙ্গুর অবস্থা তারা কাটাতে পারেনি। এখন কি ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে অর্থনীতি? জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক ধারা লক্ষ্যণীয়। যেমন ডলার সংকট কেটেছে। রপ্তানিতে ইতিবাচক ধারা আছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আশানুরুপ ফল আসেনি। যেমন মূল্যস্ফীতি কমেনি বরং বেড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা সুদের হারের ঊর্ধ্বগতির কারণে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিনিয়োগ একেবারেই থমকে গেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের মধ্যে অস্বস্তি আছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বিনিয়োগে গতি ফিরবে না। মানুষের অস্বস্তিও কাটবে না।”
দ্রব্যমূল্য এখনো মানুষের নাগালের বাইরে। সাধারণ মানুষ এই অবস্থা থেকে মুক্তি চায়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন দ্রব্যমূল্য ছাড়া অর্থনীতিতে অনেক কিছুই এখন ইতিবাচক। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "রিজার্ভের উপর চাপ কমেছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে অনেক। এখন আর ডলার সংকট নেই। বিগত সরকারের সময় ব্যাংকগুলো যেভাবে ফাঁকা করে ফেলা হয়েছিল, সেখান থেকে ব্যাংকগুলোতে একটা শৃঙ্খলায় আনা গেছে। বিশেষ করে টাকা পাচার একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক প্রবাহটা আগের চেয়ে ভালো। তবে একটা ক্ষেত্রে আশানুরূপ ফল আসেনি, সেটা হল মূল্যস্ফীতি। এটার জন্য সময় লাগবে। আমরা চেষ্টা করছি, বর্তমান অর্থবছরের শেষ নাগাদ, অর্থাৎ, আগামী জুনের মধ্যে এটাকে কতটা নিয়ন্ত্রণে আনা যায় সেই চেষ্টা চলছে। অন্তত দ্রব্যমূল্য খুব একটা কমানো না গেলেও বৃদ্ধির প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণে আনাটাই আমাদের জন্য এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ।”
চ্যালেঞ্জে আইন-শৃঙ্খলা
জানুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে বছরটি শুরু হয়েছিল। আলোচিত-সমালোচিত সেই ভোটে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। কিন্তু এ দফায় আওয়ামী লীগের শাসনামল খুব বেশি স্থায়ী হয়নি। মাত্র ৬ মাস পরই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছাড়তে হয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে। শেখ হাসিনাকে দেশ ছাড়তে হয়। গত ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মত ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।
বর্তমান সরকারের শুরুতেই বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হয় আইন -শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। মাঠ ছেড়ে চলে যান পুলিশ সদস্যরা। মূলত প্রথম কয়েকদিন চরম নিরাপত্তাহীনতায় কেটেছে মানুষের। পুলিশ ফিরলেও অনেকেই কাজে যোগ দেননি। যারা যোগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে মামলা, গ্রেপ্তার নিয়ে অস্বস্তি কাজ করে। থানাগুলো ও যানবাহন পুড়িয়ে দেওয়ার কারণে পুলিশ কাজে ফিরলেও মূল কাজ শুরু করতে অনেক সময় লেগেছে। এখনো অনেকগুলো থানা পুরোপুরি সক্রিয় হয়নি। পুলিশ সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন অনেকটা ভয়ে ভয়ে।
বর্তমানে নিরাপত্তা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পুলিশ গেছে সেখানে তাদের কাজে মনোযোগ দিতে তো সময় লাগবে। তাছাড়া গাড়ি নেই, অনেকের অস্ত্র খোয়া গেছে। ফলে সবকিছু মিলিয়ে এখন আইন-শৃঙ্খলায় স্বাভাবিক অবস্থা আসেনি। পুলিশের উর্ধ্বতন পদগুলোতে যারা যোগ দিয়েছেন, তারা চেষ্টা করছেন। পুলিশ যেভাবে ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, সেখান থেকে জনগণের বন্ধু হিসেবে মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরতে সময় লাগবে।”
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় তথাকথিত ‘মব জাস্টিস'-এর নামে বেশ কিছু মানুষকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাটিও আলোচিত হয়। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এক তরুণকে পিটিয়ে হত্যার বিষয়টি সমালোচনার ঝড় তোলে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এক শ্র্রেণির শিক্ষার্থী গিয়ে শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করে।
তথাকথিত মব জাস্টিসে'র বিষয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বছরের শুরু থেকেই তো মানবাধিকার লঙ্ঘন শুরু। একটা ভোট হলো, সেখানে জনগণ ভোট দিতে পারলো না, এটা তো মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এখন মব জাস্টিসের নামে যেটা হয়েছে, সেটা তো চরম অন্যায়। কেউ তো আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না। আগেও কিন্তু মব জাস্টিসের নামে মানুষ হত্যা হয়েছে। সেগুলোরও বিচার হয়নি। এই বিচার না হওয়ার সংস্কৃতিতে এবারও কিছু ঘটনা ঘটে গেল। আমি মনে করি, প্রত্যেকটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচার করা উচিত।”
বিচার অঙ্গনে অভাবনীয়, অনাকাঙ্খিত ঘটনা
বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সর্বোচ্চ আদালতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়। বিচারালয় থেকে পক্ষপাতদুষ্ট বিচারকদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হাইকোর্ট প্রাঙ্গনে মিছিল, সমাবেশ করে। এরপর প্রধান বিচারপতি ১২ জন বিচারপতিকে চায়ের দাওয়াত দিয়ে ছুটিতে পাঠান। এমনকি বিচারকের উপর ডিম নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন বলেছেন আইনজীবীরা।
যশোরে জামিনপ্রার্থী ১৬৭ জনের সঙ্গে তাদের আইনজীবীও গ্রেপ্তার
সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এর আগে বিচারালয়ে যেটা হয়নি, এবার সেটা হয়েছে। এত মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, অথচ জামিনের শুনানির জন্য উচ্চ আদালতে আবেদনই গ্রহণ করা হচ্ছে না। গতকালই আইন উপদেষ্টার সামনে ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেছেন, এর আগে কখনোই উচ্চ আদালতে আগাম জামিনের শুনানির আবেদন নেয়নি এমন হয়নি। জামিন দেওয়া বিচারকের এখতিয়ার। এক কোর্ট জামিন না দিলে আরেক কোর্টে আবেদন করা হয়েছে। এখন আবেদনই নেওয়া হচ্ছে না। এমনকি যশোরে একটি মামলায় ১৬৭ জন হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করেন। তাদের সবাইকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এমনকি যে আইনজীবী তাদের আদালতে হাজির করলেন, রাতের বেলায় ওই আইনজীবীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই ধরনের নজির বাংলাদেশে আগে কখনো ছিল না।”
বর্তমান সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে পুনর্গঠন করেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময়ের হত্যাকাণ্ডের অপরাধের বিচারের ভার দেওয়া হয়েছে এই ট্রাইব্যুনালে। ইতিমধ্যে ট্রাইব্যুনাল থেকে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোর্টিশ জারি করার জন্য পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠিও পাঠানো হয়েছে ট্রাইব্যুনাল থেকে।
যে রায়ের পর বদলে গেল সবকিছু
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির সব কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে। তিন বছর পর ২০২১ সালে সেই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সাতজন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত ৫ জুন রায় দেন বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ। রায়ে কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে কোটা বজায় রাখতে নির্দেশ দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব, পরিপত্র জারি করতে নির্দেশ দেন।
এরপর জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কোটা পদ্ধতির যৌক্তিক সংস্কার চেয়ে নতুন করে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলন শুরু হয়। ১৪ জুলাই ‘সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি আদালতেই ফয়সালা করতে হবে' বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া ‘রাজাকার' সংক্রান্ত তার একটি বক্তব্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আরো চাঙ্গা করে তোলে। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে।
এ ঘটনায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্র সমাজ। ১৬ জুলাই ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মধ্যে পুলিশ গুলি চালায় এবং ছাত্রলীগ হামলা করে। রংপুরে প্রাণ হারায় রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। গত ১৮ জুলাই সারা দেশে ‘শাটডাউনের' ঘোষণা দেয় আন্দোলনকারীরা। তাদের এ কর্মসূচিতে প্রায় অচল হয়ে পড়ে সারা দেশ। বিভিন্ন স্থানে নিহত হন ৪১ জন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন রূপ নেয় গণ অভ্যুত্থানে। ৩ ও ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার ব্যাপক আন্দোলন ও শহীদ মিনার থেকে সরকার পতনের এক দফা ডাক দেওয়া হয়। ৫ আগস্ট ‘ঢাকায় চল' কর্মসূচির মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান।