সেখানে তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সূত্রপাত হয়। বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরুর বয়স ফাইভ প্লাস। যদিও বাংলাদেশের শহরাঞ্চল, গ্রামাঞ্চল এবং সুবিধাপ্রাপ্ত এবং সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন।
শহরাঞ্চলের সুবিধাপ্রাপ্ত শিশুরা তিন বছর পার হলেই তাদের একাডেমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়ে যায়। তারা কিন্ডারগার্টেনমুখী হয়। সেই কিন্ডারগার্টেন কালচার আবার এক হযবরল কালচার। কোথাও ইংরেজিপ্রধান, কোথাও আরবিপ্রধান, আবার কোথাও দুয়ের মিশেল।এক্ষেত্রে অভিভাবকদের ইচ্ছায় শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার পরিপ্রেক্ষিত রচিত হয়। এই ধারার কোনো সমন্বিত লক্ষ্য উদ্দেশ্য কারিকুলাম নেই। আর সুবিধাবঞ্চিত, অপেক্ষাকৃত দরিদ্র শিশুরা যায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এই ছবি সুস্পষ্ট।
কিন্তু জাতীয়ভাবে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং নীতিমালা নির্ধারণ করা থাকে। একটি জাতির ভবিষ্যৎ সোপান নির্মিত হয় প্রজন্মের হাত ধরে আর প্রজন্মের যাত্রা শুরু হয়। কাজেই প্রাথমিক ধাপের শিক্ষার লক্ষ্য উদ্দেশ্যের উপর নির্ভর করে পরবর্তী শিক্ষার ধাপের লক্ষ্য উদ্দেশ্য, পক্ষান্তরে জাতির গন্তব্য এবং প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটে।
সারাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার হাল-হকিকত জানতে হলে মাঠ পর্যায়ে বিদ্যালয় গুলি পরিদর্শন করার বিকল্প নেই। এখানেও এলাকাভেদে দেখা মিলবে ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতার। শহরাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-ছাত্রী হার যত কম,অপেক্ষাকৃত শহর থেকে দূরবর্তী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে সেই হার বেশি।
কেন এই ভিন্নতা? তার উত্তর খুঁজতে গেলে আর্থ সামাজিক, রাজনৈতিক ও বৈশ্বিকতার প্রেক্ষাপটও বিবেচনায় নিতে হবে।
বিগত সরকার শিক্ষাজীবনের ভিত গড়তে ও শিশুদের মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে দুটি প্রকল্প হাতে নিয়ে ছিল। পি ই ডি পি ৩ প্রকল্পটি গ্রহন করা হয়েছিল ২০১১ সালে। ১৮ হাজার ৫৩ কোটি ৮৮ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকার এই প্রকল্পটি শেষ হয় ২০১৭ সালে। ২০১৮ সালে আবার গ্রহন করা হয় পি ই ডি পি ৪, ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত যার ব্যয় ১৫ হাজার ৩১৯ কোটি ৭৬ লক্ষ টাকা। দৈনিকের রিপোর্টটিতে জানানো হয়েছে, এই প্রকল্প দুটির বিশাল ব্যয়ে ভৌত ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও সামগ্রিকভাবে অবনতি ঘটেছে শিক্ষা মানের৷ অর্জিত দক্ষতার স্তর নির্ণয়ে বাংলা এবং গণিত বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছে মাত্র ৩০ ভাগ শিশু।
প্রাথমিক শিক্ষায় মূলত শিশুদের সকল শিক্ষা শ্রেণিকক্ষভিত্তিক করা ছিল এই উদ্যোগের অন্যতম দিক।
প্রথমেই বলছিলাম, আমাদের সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের শিশুদের সাধারণত প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ করে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্কুলগুলোতে ভর্তি হয় প্রান্তিক ও দরিদ্র শ্রেণি পেশার মানুষের সন্তানেরা। রিপোর্ট উল্লেখ করা হয়েছে, এই প্রকল্পের সুফল এই যে ঝরে পড়া শিশুর হার কমে গেছে।
মূলত প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে উপবৃত্তি চালু করাও এর পেছনে অন্তর্নিহিত একটা বিরাট কারণ।
বিণামূল্যে বই প্রদান,উপবৃত্তি প্রদান,বিনা বেতনে পড়াশোনা এবং পরীক্ষাবিহীন শিক্ষা সিস্টেমের পরও কেন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা গেল না এত বৃহৎ আকারের বাজেটের প্রকল্পে?
সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মকর্তারা গত কয়েক বছরে প্রাথমিক শিক্ষার অবনমনের জন্য কোভিড পরিস্থিতিকে দায়ী করেন সবচেয়ে বেশি।
যে কোনো কারণেই হোক, আমাদের প্রাথমিক শিক্ষায় দক্ষতার মান অর্জন করা যায়নি৷ আমাদের শতভাগ শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়মুখী করা যায়নি৷
এর জন্য লক্ষ্যহীন শিক্ষাব্যবস্থাকেই দায়ী করতে হবে সর্বাগ্রে৷ একটি জাতি রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে যায় শিক্ষাক্রম,শিক্ষা ব্যবস্থা, লক্ষ্য উদ্দেশ্য সবকিছু। যে সরকারই আসুক, সবার আগে নষ্ট হয় শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের শিশুরা হয়ে ওঠে গিনিপিগ।সবাই সবার রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে শিক্ষাব্যবস্থাকে। ৫৪ বছর অতিক্রান্ত। এখনো জাতির কোনো শিক্ষানীতি নেই। মৌল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে যেখানে এখনো বিতর্ক বিদ্যমান শিক্ষা তো আসলে তার বাইরের কিছু নয়।
শিক্ষার লক্ষহীন জাতি এই নষ্ট, ভ্রষ্ট রাজনীতির উপজাত। রাজনীতির ভিত ঠিক না হলে শিক্ষার সুফল আশা করা দুরাশা। আমাদের দেশের শিশুরা বড়ই অসহায় এই রাজনীতির কাছে৷ আর দুর্ভাগা এই জাতি যার প্রজন্ম রাজনৈতিক হীন স্বার্থের কাছে জিম্মি হচ্ছে বারবার।